শুক্রবার, ২১ এপ্রিল, ২০১৭

আমাদের বৈশাখ আনন্দ

চৈত্র সংক্রান্তির আগেরদিন থেকে বৈশাখের প্রথমদিন, ছেলেবেলাকার সময়ে এই তিনটি দিন আমাদের কাছে বিশেষ ছিল, ছিল আকাশ ছৌঁয়া আনন্দের। আনন্দের মাত্রা যদি জানতে চান, তবে বলি- এ আনন্দ বাতাস কেটে-কেটে সুখে ভেসে বেড়ানো ঘুড়ির মতন। মনটা কি রকম জানি ভাবাবেশে আকাশে নিরলে ভাসবার অবকাশ পায়!

খুব বেশীদিন আগের কথা নয়, বছর ১৫ ফিরলেই হাতের নাগালে উজ্জিবিত অতীতের ছৌঁয়া কিছুটা খুঁজে পাই, ছুঁতে পাই। মনে পড়তেই ফিরি চৈত্র সংক্রান্তির আগেরদিন ভোর হতেই শুরু হওয়া আমাদের আনন্দ ঘনঘটার আয়োজন। ঘুম থেকে উঠেই বেরিয়ে পড়া আঙ্গিলা ফুল আর আপনফুলের খোঁজে। এই দুটো ফুলের খোঁজ পাওয়া কিছুটা কষ্টসাধ্য ছিল, ফুলের গাছগুলো আপনা হতে বাগানে উঠত এবং অপ্রয়োজনীয় বলে লোকজন বাগান পরিষ্কার করতে কেটে ফেলত। ফলত বাগানে এই দুটো ফুলের গাছ মিলত খুব কমই। ফুলের জন্য তখন আমরা ঘন জঙ্গলভরা বাগানেও গিয়ে পৌঁছতাম, যেখানে ছিল কল্পিত দু‘মাথাওয়ালা ভূত আর সাপের ভয়! কিন্তু ফুল সংগ্রহের ব্যাপারটা তখন প্রতিযোগীতার বলে ভয়টা কিছুটা কুঞ্চিত হয়ে পড়ত!

সারাটা সকাল ফুল সংগ্রহ শেষে তা ফুলের ঝুড়িতে রেখে দিলে দিদিরা সময় করে বসে-বসে ফুলের মালা গাঁথত, আর আমরা তখন কাস্তে-দা নিয়ে ছুটে যেতাম রাস্তারধারে-মাঠে। তখন মাঠে আপনা হতে জন্মাত ধুছনি গাছ, বিষকাটালি গাছ, গাগরা গাছ আর রাস্তার পাশের গাছ হতে মিলত বিভিন্ন কাঁটা (যেমন: মান্দার কাঁটা, মন কাঁটা, বেল কাঁটা, বরই কাঁটা, নাটাই গাছের কাঁটা ইত্যাদি), আমরা কাঁটা আর গাছগুলো ইচ্ছেমত কেটে একটা নির্দিষ্টস্থানে এনে শুকোতে দিতাম। সারা দুপুরের পোড়া রোদে গাছগুলো শুকনো জ্বালানির উপযোগী হলে আমরা তা উঠোনে এনে জড়ো করতাম।

সাঁঝ নামবার আগেই মা-কাকীরা ব্যস্ত থাকতেন কড়ই (চাউল ভাজা) আর খই গুড়ো করার কাজে। আমরা ছোটরা তখন দলবেঁধে ছুটছি প্রকৃতির কাছে তাকে জেগে থাকবার আকুতি নিয়ে। আগামী কাল বছরের শেষ দিন, তাই আমাদের সাথে-সাথে প্রকৃতিও আনন্দে সারা হবে সারাদিন-সারারাত্রি। এ প্রচলিত রেওয়াজ-রীতি, প্রাচীন ঐতিহ্য! আর তাই আমরা যখন বাড়ির চারপাশ-মাঠ-রাস্তায় ঘুরে-ঘুরে মাতিয়ে তুলছি-

“গাছ-গাছালি জাগিও, 
কাইল বিয়ানে (সকালে) বিশুদজলে (বিশুদ্ধ পানিতে) স্নান করিও
পুষ্পমালা গলায় দিও।”

তখন চারিদিকেও সমস্বরে বাজছে সে আওয়াজ, যেন প্রকৃতি সে বার্তা খুব আনন্দের সহিত ছড়িয়ে দিচ্ছে! অনেকক্ষন আনন্দে নেচে গেয়ে চলে আমাদের সে আনন্দ অনুভূতির প্রকাশ।

সন্ধ্যের আলো গাঢ় হলে আমরা সবাই ঘরে ফিরি। ততক্ষনে বাড়ির প্রতিটি ঘরে-ঘরে তৈরি হচ্ছে লাবন (চাউলের কড়ই বা ধানের খই ভেজে পরে শীল-পাটায় মিহি দানা করে গুড় অথবা গুড়-নারিকেল সংমিশ্রনে সুন্দর কারুকার্যে বানানো সুস্বাদু খাবার)। ঘরে ফিরলে মা-কাকীরা লাবন তুলে দিত খাবার জন্য। পেট পুরিয়ে লাবন খেয়ে কখন যে ভাত না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছি আমরা জানতামই না।

তখনও হয়ত ফজরের আযান পড়েনি। মা ডেকে তুলছে বাবু-বাবুরে উঠ-উঠ সবাই উঠে গেছে, বিষকাটালি পুড়বি না? প্রশ্নটা কানে বাজতে আর দেরী হয় না। আড়মোড় ভেঙ্গে উঠোনে বেরিয়ে আসি। তখন কেউ-কেউ বিষকাটালি, ধুনছি, গাগরগাছ, কাঁটা, খড় সমেত জ্বালাচ্ছে, কেউ জ্বালাবার আয়োজন করছে। আমরাও নেমে পড়ি। জ্বালাতে গিয়ে ধৌয়ায় চোখে জ্বালা ধরার, কিন্তু উৎসাহ আর আনন্দের মাত্রায় তাতে ভাটা পড়ে না। কিছুক্ষনের মধ্যে আগুন জ্বলে উঠে, জ্বলতে থাকে শুকনো গাছ আর কাঁটা। আমরা তখন ধৌঁয়া পরস্পরের গায়ে মাখি। আর আনন্দে সমস্বরে চিৎকার দিয়ে বলতে থাকি-

“আঙ্গো বাড়ির মশা-মাছি দূরে রে দূরে..! 
আঙ্গো বাড়ির অসুখ-বিশুখ দূরে রে দূরে দূরে..!”

আনন্দের মাত্রা বাড়তে থাকলে তা শয়তানিতে পরিনত হয়, তখন সুর উঠে-
“আঙ্গো বাড়ির শয়তান-বদমাইশ দূরে রে দূরে..!
আঙ্গো বাড়ির চোর-ডাকাইত দূরে রে দূরে দূরে..!”

আসলে সব আয়োজনই প্রতীকি। প্রতীকি আয়োজনের রেশ ধরেই ধৌয়ায় উড়িয়ে দিতে চাই মনের সমস্ত ভয়, অহং, পীড়া, জরাজিহ্নতাকে, লোভ, ক্ষোভ, পাপ-তাপকে।

যখন আবছা আলো-ছায়ার খেলা সাঙ্গ হচ্ছে কেবল, তখন থেকে মা-দিদি-কাকী-জেঠি‘রা বাড়ির পাশের মাঠ হতে ডিমাই শাক, থানকুনি শাক, কুমড়োর ডাটা, মাইরার ডাটা, আইল্লা (কলা গাছের অভ্যন্তরের নরম অংশ), কাঁচা কলা, বন আইডগা (বাগানে জন্মানো কাঁটাযুক্ত একধরনের সরু কচু), কচুর লতি, ঢেঁকি শাক, পুঁই শাক, কাঁচা কাঠাল ইত্যাদি সংগ্রহ করে। এরপর সবাই মিলে উঠোনে বসে শুরু হয় কাটা-কুটি। কাটাকাটির আইটেমে আরও যোগ হয়- কাঁচা আম, কাঁচা পেঁপে, মিষ্টি কুমড়ো, মিষ্টি আলু, সাজনে ডাটাসহ আরও সুবিধাজনক আইটেম। আর এইসব আইটেম একযোগে পাঁচপোড়নের সম্বাদে রান্না হয়ে তৈরী করা হয় সবচেয়ে সুস্বাদু খাবার “পাচন”, তবে কেউ-কেউ বোধকরি “সুপ্তী” বলে থাকে।

দুপুর হতেই বাড়িতে কাঁচা হলুদ আর নিমপাতা বাটা হয়। বাটা কাঁচা হলুদ আর নিমপাতা বৎসরের শেষ দিন গায়ে মাখতে হয়। আসলে এইদিন নিজেকে সম্পূর্ণ প্রস্তুত করা হয়, নিষ্কোমল মন নিয়ে নতুন বৎসরটিকে শুরুর প্রত্যাশায়। এরপর স্নান করতে যাবার কালে বাদিগাছের ফল হাতে করে নিয়ে স্নান করার সময় পানিতে ডুব দিয়ে খেয়ে নিতে হয়। প্রাচীন বিশ্বাস এতে নাকি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে।

স্নান সেরে এসে পরিষ্কার পোশাক পড়ে নারীরা আঙ্গিলা ফুলের মালা ঘরের সন্মুখ দরজায় লাগায় আর আপন ফুলের মালা গরুর গলায়, আর পুরুষরা শত্রু কাটাকাটি খেলে। পুরুষ ছেলে-বুড়ো সবাই এই খেলায় অংশ নেয়। খেলার নিয়ম হল- মাটিতে কাস্তে বা লোহার ফলা দিয়ে মানুষের মত করে একটা ছবি আঁকতে হয়, তারপর তার উপরে এক-দুই মুষ্টি খই ছিটিয়ে ছবির উপর একটা কাঁচা আম বসিয়ে তা কাটতে হয়। কাটার সময়কালে পাশে থাকা একজন তাকে জিজ্ঞাসা করে- 

কি কাট কি কাট?
যে কাটে সে জবাব দেয়-
আম কাটি...
এরপর আবার প্রশ্ন আসে-
আর কি কাট?
উত্তরে- শত্রুর মাথা কাটি। বলেই আমটিকে এক কোপে কাটা হয়।

এরপর শুরু হয় খাওয়া-দাওয়ার পালা। চৈত্রের শেষ দিন নিরামিষ খেতে হয়। এই দিন পাচনের সাথে সামার্থ্য অনুযায়ী খাবারের আইটেমে থাকে চাটনি, দধি আর মিষ্টি জাতীয় মুখরোচক খাবার।

বৈশাখের প্রখমদিন সবাই ভালো-মন্দ খেতে চায়। বেশিরভাগেরই বিশ্বাস এইদিনটি মন্দ হওয়া মানে বছরের বাকি দিনগুলোও মন্দ যাওয়া। তাই এই দিনটাকে সবাই নিজেদের মতো করে উপভোগ করার চেষ্টা করে।

আনন্দের দিনগুলো খুড়িয়ে এসেছি। এখন যান্ত্রিক জীবনে আনন্দসারা হয় অফিসের কাজের চাপে। কিন্তু জীবনে ফেলে আসা আনন্দের দিনগুলো একটু নিস্তব্ধতা ফেলেই হাতছানি দিয়ে ডাকে। সময়েগুলো কালাকালে ব্যাকুল হয়ে রয়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন