বিদ্যালয়ের স্মৃতিকনা লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
বিদ্যালয়ের স্মৃতিকনা লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

বৃহস্পতিবার, ২৩ জুলাই, ২০১৫

বড়দিদি

পরীক্ষার রেজাল্ট হাতে দাঁড়িয়ে বড়দিদি, অমনি বুকটা ধড়পড়-ধড়পড় করতে লাগল। বড়দিদি বলতে থাকলেন তাঁর কথাগুলো আর তা বুকের মাঝে চেল হয়ে ক্রমাগত বিঁধতে থাকল। মাঝে-মাঝে শ্রেনীকক্ষে প্রবেশ করেও দিদি তাঁর বাক্যবানে স্তব্ধ করে দিতেন আমাদের।

সময়ের পরিক্রমায় আজ বুঝি, শাসনের যে বাক্যবান আমাদের হৃদয়কে একদিন ক্ষত-বিক্ষত করত। সে বাক্যবান সময়ে বুঝলে হয়ত আজকে আমরা সকলে ধারণ করতে পারতাম এক একটা গৌরবময় মুকুট।

বুধবার, ২২ জুলাই, ২০১৫

বিদ্যালয়ের কিছু বেদনাময় স্মৃতি

পৃথিবীতে সবাই বেড়াতে আসে। বেড়াতে এসে কেউ নিতে চায়, কেউ দিতে চায়, কেউ সময় নিয়ে ঘুরতে চায় আবার কেউ সময় হেলে ছুটতে চায়। সময়ের এই খন্ডিত জীবন বলয়ে তাই সকলেই প্রায় আবেগ তাড়িত, তবে আমার আবেগটা বোধহয় আর সকলের থেকে একটু বেশীই। আসলে সত্যটা কি, আমি এখনও ছায়াছবির কোন আবেগী দৃশ্য দেখে নিজেকে সামলাতে পারি না, চোখ থেকে অনর্গল পানি ঝরতে থাকে কোনে এক অদৃশ্য কাতরতায়। এই জন্য বন্ধু-বান্ধবদের পাশে থাকাকালে আবেগী ছবিগুলো একটু এড়িয়েই চলি, কেননা কেউ যদি আমার আবেগের অস্ফালনটা দেখে ফেলে, যদি লজ্জায় পড়ি!

স্মৃতির ছায়াগুলো আমাকে খুব বেশী দাবড়িয়ে বেড়ায়। বেখেয়াল হলেই কানে ভেসে আসে পঞ্চমশ্রেনীতে টেসি দিদির দুখুকে উদ্দেশ্য করে বলা কথাগুলো। দুখু, পড়ালেখা তোকে দিয়ে হবে না রে। তোর মাকে আর কষ্ট দিস না, সে কত কষ্ট করে দিন-রাত খেটে তোর পড়ার খরচ জোগাচ্ছে, অথচ তুই ঠিকমতো পড়িস না। বলি- কোথাও কাজে লেগে যা, তাতে অন্তত মায়ের কষ্টটা কমবে। পঞ্চম শ্রেনীর পর আমরা আর দুখুকে পাই নি। জানি না দুখু কি তার মায়ের কষ্ট লাঘব করতে ছুটেছে কিনা, নাকি সবভূলে এখনও সে নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত।

আব্দুল সাত্তারের কথাও মনে ভাসে, বেচারা নাকি সারাদিন-রাত বই নিয়ে পড়ে থাকত। অথচ পরীক্ষার ফলাফলে ও ওর পরিশ্রমের নূন্যতম সিকিও অর্জনে সমর্থ হত না। মোরশেদ স্যার মাঝে-মাঝেই বলতেন ছেলেটার প্রচেষ্টা আছে অথচ ওর মাথায় কিছুই থাকে না। সপ্তম শ্রেনীর পর আব্দুল সাত্তারকে আর পেলাম না।

জীবনের রঙ্গশালায় তার হাতে সময় খুব বেশী ছিল না। জীবন থেকে হয়ত কিছু পাবার কিংবা নেবার সময় হয়েছে মাত্র, ঠিক তখনই মিতু পাড়ি দিয়েছিল অচিন পথে। সেদিন বিদ্যালয় থেকে মেজদি আর সংগীতা দিদির আসতে বিকেল হয়ে গেলে দেরির কারণ জিজ্ঞাসা করতেই জানতে পারি মিতু নিরুদ্দেশের পথে পাড়ি দিয়েছে, আরও জানতে পারি তার বাবাও নাকি ঠিক কয়েকদিন আগেই গত হয়েছেন। মেয়েটি নাকি বাবার জন্য খুব পাগল ছিল! তাই বাবার শোকটা কাটিয়ে নিজেকে সামলিয়ে নিতে পারে নি। সেদিন বসে-বসে খুব হিসেব মিলাই, ঠিক কতটা মমতা কিংবা ভালোবাসার মোহ থাকলে বাবার পথে নিজেও অচিন দেশে ছুটে যাওয়া যায়?

স্মৃতিগুলোর যন্ত্রণা খুব বেশী, ভুলতে চাই পারি না আবার পালাতে ছুটলে পা পিছলে বারবার পড়ে যাই। বলি- কষ্টের মন্ত্রণাগুলো কেন আমার আদ্যপৃষ্ঠে এতটা জড়িয়ে থাকে? কেউ কি ভালো বলতে পার?

বুধবার, ১৫ জুলাই, ২০১৫

বিদ্যালয় জীবনে সেন স্যারের রেখে যাওয়া যে স্মৃতি আজও হাসায়

সপ্তমশ্রেনীতে সেন স্যারের মতো ভয় অন্য কাউকে বোধহয় খুব কমই পেতাম। কারণ স্যারের শ্রেনীকক্ষে প্রবেশ মানে ধুমম্ মাইর হবে।

স্যার শ্রেনীকক্ষে ঢুকে প্রথমে পড়ার জন্য ডাকতেন খ্রীষ্টান বন্ধুদের। তাদের পালা শেষ হলে এরপর উল্টো-প্লাটা রোল দিয়ে ডেকে তাদের পালা। পড়া শেখা থাকলেও মাইর খাওয়া নির্ভর করত স্যারের মর্জির উপর। সে হিসেবে বলা যায় রোল এক হোক বা একশ, মাইর খাওয়াটা সবার মোটামুটি নিশ্চিতই ছিল। আর তাঁর পড়ানোর ধরনও সম্পূর্ণ ভিন্ন, আসলেই Tense, Translation, Essay, Paragraph এই চার-পাচটা গন্ডিতেই আবদ্ধ ছিলেন।

স্যারের শ্রেণীতে অবস্থান আমাদের কতটা আতঙ্কিত কিংবা তত্রস্থ করত তা বলার অপেক্ষা রাখে না। স্যারের সেদিনকার দিনগুলো এমন আচারণই হয়ত আজকে আমাদের স্যারকে সবচেয়ে বেশী মনে করার প্রধান কারণ।

স্যারের মুখের সে কথাগুলো যে, কথাগুলো আমরা বন্ধুরা এখনো কয়েকজন এক হলে মনে করতে থাকি, খ্রীষ্টান বন্ধুদের ডাকতে গেলে- খ্রীষ্টাইন্না বেগ্গুন একত্তরে চলি আয়, লেখতে বললে- ১০-১২ পৃষ্ঠা লেই হালাও, লেখা থামাবার সময়- স্ট্যান্ড আপ একপায়ে টেবিলের উপর, মারতে গেলে উত অই যাও উত অই যাও টেবিলের নিচে মাথা দি উত অই যাও, মাইরের আগে কেউ কিছু বলতে চাইলে স্যার বলতেন- আগে মাথা পরে কথা, মাইর দিতে গেলে কেউ যদি স্যার স্যার বলে মাপ করার বাসনা করত- স্যারের জবাব সাগু সাগু করিও না, সাগু সাগু করিও না, সাগু সাগু করি বছরের ১০ মাস খাইয়ালাইছ।

অন্যদের পিটানোর মাঝে স্যারের কমিকগুলো এমন ছিল যে, আমরা এত আতঙ্কের মধ্যেও মাঝে-মাঝে হেসে ফেলতাম। তখন স্যার বলত- হাইসোনা, পালা আইয়ের। মাইরের ভয়ে কয়েকজন জিন্সের প্যান্টের ভিতর কাছা (গোছ) মেরে লুঙ্গি পরে আসত। উৎ করে পিটানোর সময় স্যার যখন দেখত স্যারের মাইর ঠিক মতো লাগছে না তখন দাঁড় করিয়ে শরীরে পিটাত। পরে অবশ্যই পোলাপাইন স্যারের ধরে পেলাটাকে ধরতে পেরে কোচ মারা লুঙ্গির উপরে জিন্সের প্যান্ট পড়েও মাইরের সাথে-সাথে জোরে চিৎকার করে আঘাত পাওয়ার ভাব দেখাত।

আমাদের শ্রেনীতে বয়সের তুলনায় লম্বা সারির ছিল রহমান, বর্মাকেন্টিন (ওর নাম ভূলে গেছি, তাই স্যারের দেয়া নামেই চালিয়ে দিলাম ) , লুক, জোনাস, জিকোসহ বেশ কয়েকজন। রহমান লম্বায় স্যারের থেকেও প্রায় একহাত উঁচু ছিল। তাকে পিটানোর পর আমরা তাকে কখনও আঘাত পেয়েছে এমন কোন ভাব তার মুখে দেখিনি। স্যার তাই তার নাম দিয়েছে স্টিক টাইট। বর্মাকেন্টিন কে নিয়ে স্যারের অজুহাত ছিল বেশ। ও নাকি বর্মাকেন্দ্রীতে একটা কেন্টিনে বসে লুকিয়ে সিগারেট খেত। লুক আব্দুর রহমানদের দলের লোক, অনেক মাইর খাওয়ার পরও যখন ওদের মধ্যে কান্নার কোন ভাব আসত না, তখন স্যার উত্তেজনায় মুখের থু-থু চারিদিকে ছড়িয়ে মারতে-মারতে বলতে থাকত লুকুচ্ছা-ফুকুচ্ছা হুস-হাছ ঠুস-ঠাস হুয়া-হুয়া।

নাকি কাঁদার মতো আমাদের শ্রেনীতে বয়সের তুলনায় কম লম্বা ছিলাম - আমি, সাত্তার, ফারুক, ওয়াছি, আরিফ, কনক, জিয়া, নাজিম, নিতু, সুমনসহ বেশ কয়েকজন। বেতকে আমার জন্মের ভয় ছিল, তাই যখনই আমার ডাক পড়ত আমি স্যারের বেতের সামনে গিয়েই কেঁদে দিতাম। আর গায়ে বেত পড়াত মানে ১০-২০ মিনিটের কান্নার ব্যবস্থা। আরিফকে মাইর দিলেই ও লাফিয়ে উঠে গাল ফুলিয়ে শব্দ করত উফস্ । কনকের গাল তুল-তুলে ফোলাই ছিল, তাই যখন ওকে মারত মুখ দিয়ে কেবল উহ্ উহ্ করত আর তার শরীর রক্তবর্ণ ধারন করত। সাত্তারকে মাইর দিলেই ও শরীরকে বাঁকিয়ে এমন ভাব করত যে না হেসে পারা যেত না। জিয়া (শিমুল) ‘র এলার্জির সমস্যা ছিল, তার শরীরের যেখানটায় মাইর পড়ত সেখানটায় ফুলে এমন টইটম্বুর হত যে, কিছুক্ষন হয়ত চেনাই মুশকিল ছিল । অবশ্য স্যার আমাদের পিচ্ছিদলের অবস্থা বুঝত, তাই আমরা অন্যদের হিসেবে অনেক কমই বেত খেতাম।

জনি, রিটুল, রাহাত, মথি, সোহাগ (টিটলি ভাইয়া) স্যার এদের প্রতি একটু স্পেশাল কেয়ার নিত, মানে বড় গ্রুপের সাথে এরাও প্রায় প্রতিদিনই ধরা খেত। তবে রহমানসহ অন্যদের পিটানোর পর ওদের পিটানোর মত একটা শক্তি স্যারেরও ছিল না ।

স্যার পড়া ধরলেই বোর্ডে সামনে নিয়ে যেত বলত কোগা অ্যাসে, প্যারাগ্রাফ শিখছ বোর্ডে লেখি হালাও। কেউ যদি কি লিখবে বুঝতে না পেরে দাঁড়িয়ে থাকত- তখনই পিঠে ধুপ্ ধুপ পড়ে যেত। মাইরের ঘোরে কেউ যখন দিশা হারিয়ে এদিক-ওদিক ছুটাছুটি করত, তখন স্যার তার পিছে ছুটে গিয়ে মারত। তবে দৌড়ে গিয়ে নিজের আসনে বসতে পারলে অনেক সময়ই হাঁফ ছেড়ে বাঁচা যেত।

আমাকে এখনো স্যারের যে কর্মকান্ড বেশী হাসায় তা হল- মিরাজকে পড়ার জন্য ডাকলে স্যার মিরাজের সাথে-সাথে মনঞ্জুকেও ডাকত। মূলত দু‘জনের মধ্যে সখ্যতার কারণেও হয়ত স্যার এটা করত। মিরাজ স্যারের মাইরের হাত থেকে বাঁচতে অস্পষ্ট গুনগুনে পড়া বলতে থাকত। যেহেতু মনঞ্জুর সাথে তার সখ্যতা বেশী, তাই স্যার মনঞ্জুকে নিয়ে আসত মিরাজ কি বলতেছে তা বলার জন্য। এখানে মিরাজের কাজ ছিলো মনঞ্জুর কানে-কানে পড়া বলা। আর মনঞ্জুর কাজ ছিলে মাইক হয়ে সে পড়াটা স্যারের কাছে পরিবেশন করা। কিন্তু সমস্যা হলে গিয়ে- মিরাজের ত পড়া শেখা ছিল না, সে মনঞ্জুর কানেও বিড়-বিড় করে পড়া বলত আর মনঞ্জু তার মাইকে কি বলবে সে বুঝতে না পেরে ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকত। অবশেষে দুজনের উপর একধাপ পড়ে পালা শেষ হত.....

শুক্রবার, ১০ জুলাই, ২০১৫

আমার ব্রাদার আঁন্দ্রে উচ্চ বিদ্যালয়ের দিনগুলো-০৩ঃ

পঞ্চম শ্রেণীর আমার প্রথম ক্লাস। শ্রেণীতে আমাদের শ্রেণী শিক্ষক ছিলেন শ্রদ্ধেয় শ্রী অতুল চন্দ্র সূত্রধর যাকে আমরা অতুল স্যার বলে জানতাম। আমরা যখন পঞ্চম শ্রেণীতে, তখন তিনি বয়সের ভারে কিছুটা ন্যুজ। কৃষ্ণকালো পাতলা গড়নের শরীর, মাথায় টাক বর্তমান। শারীরীক বিবেচনায় নিয়ে যদি বয়সটাকে বলি তবে ৬০ বছর অতিক্রান্ত করেছেন সে নিঃসন্দেহে বলা চলে। যা হোক, স্যারকে পেয়ে মনটা বেশ ফুরফুরে হয়ে গেল। কারণ যার গানের চমৎকার গলা, তিনি মানুষটা যে চমৎকার হবেন তা নিজের বিবেচনায় বুঝতে পারলাম। স্যার হাজিরা খাতা নিয়ে শ্রেণীকক্ষে প্রবেশ করলেন এবং সকলের হাজিরা সম্পন্ন করলেন। হাজিরা নেয়া সম্পন্ন হলে, স্যার আমাদের বিদ্যালয়ের নিয়ম-কানুন, লেখা-পড়া প্রভৃতি বিষয়ে বেশ কিছু মূল্যবান উপদেশ দেন। স্যার যখন হেঁটে-হেঁটে আমাদের জ্ঞাণের পরিধিকে বিস্তৃর্ণ করছেন, তখন আমরা অবাক চিত্তে তাঁর মুখ নিঃসৃত বাণী শ্রবণ করছিলাম। স্যার বললেন দেখ সন্মানের জায়গাটা সবসময় মনে রাখবে, যে তোমাকে জীবনে একটা শব্দও শিক্ষা দিয়েছে সে তোমার গুরু। তাই পথে-ঘাটে যেখানেই কোন শিক্ষক-শিক্ষিকাদের দেখবে তাঁদের সন্মান করবে। স্যারের হাতের লেখাটা বেশ চমৎকার ছিল। পঞ্চম শ্রেণীর আমার বার্ষিক পরিক্ষার ফলাফলের কাগজে স্যারের সেই আর্ট করা লেখা আজও বোধ করি আমাদের ঘরে রক্ষিত আছে। অতুল স্যার পঞ্চম শ্রেণীতে আমাদের দুটো ক্লাস নিতেন। প্রথম ঘন্টায় বাংলা এবং শেষ ঘন্টায় সমাজ।

প্রথম ঘন্টা শেষ হলে দ্বিতীয় ঘন্টায় এলেন শ্রদ্ধেয়া টেসি দিদি, পুরো নাম যতটুকু মনে পড়ছে তাতে মনে হয় টেসি গোনছালবেজ‘ই হবে। বিদ্যালয়ে আমরা শিক্ষকদের স্যার আর শিক্ষিকাদের দিদি ডাকতাম, সে হিসেবে তিনি টেসি দিদি। দিদি এসেও আমাদের বিভিন্ন উপদেশ দিলেন। দিদির যে উপদেশটি আমার আজও মনে গেঁথে আছে তা হল- “একটা সময় তোমরা অনেকে অনেক বড় হবে, কিন্তু একটা কথা সব সময় মনে রাখবে- কখনও মুরুব্বি বা শ্রদ্ধেয় জনদের সামনে পা তুলে বসবে না।” দিদির সে উপদেশটি আমি আজও রাখার চেষ্টা করছি। টেসি দিদি সম্পর্কে বলতে গেলে বলতে হয়- তাঁর বয়স ৪০ ছুঁই-ছুঁই করছে। শারীরী গড়নটাকে মোটামুটি মোটা বলা চলে, গৌর বর্ণের। দিদি আমাদের গণিত আর ইংরেজী ক্লাস নিতেন। দিদির সংস্পর্শে থেকে আমরা যে গুণটিতে অভ্যস্ত হয়েছি, সে ছিল দ্রুত লেখার চর্চ্চা। তিনি বোর্ডে লেখার সময় এত দ্রুত লিখতেন যে, মাঝে-মাঝে আমরা হাঁফিয়ে উঠতাম।

অতুল স্যার, টেসি দিদি ছাড়াও আরও একজন আমাদের শ্রেণীতে পাঠদান করতেন, তিনি মমতাজ দিদি। ফর্সা স্লিম চেহারার এই দিদি ছিল আমার পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষাজীবনের আতঙ্ক। আসলে হল কি- দিদি আমাদের পঞ্চম ঘন্টার ক্লাসটি নিতেন। ক্লাসের মধ্য বিরতির ঠিক পর-পরই আমাদের শ্রেণীতে এলেন দিদি। মধ্য বিরতির পর দিদি শ্রেণীতে ডুকে পাঠদান শুরু করলেও আমি সুদেবের কাঁদে হাত রেখে কথায় মশগুল। দিদি শ্রেণীতে প্রবেশ করেছেন তাতে আমার নূন্যতম খেয়ালও নেই। হঠাৎ আমার মাথায় উপর ছুটে এল দিদির হাতের বুরুশ আর কানে দিদির কণ্ঠ, বেদপ ছেলে কোথাকার। বুরুশ মাথায় পড়লে আর দিদির চিৎকারে আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। স্তম্ভিত ফিরে যখন আমার ভূলটি বুঝতে পারলাম, ততক্ষণে আমাকে দিদি কান ধরিয়ে শ্রেণীর বাহিরে দাঁড় করিয়ে রাখলেন। সে দিন থেকে দিদির শ্রেণীতে আমার মতো ভদ্র ছেলে খুঁজে পাওয়া মুশকিল ছিল বটে।

রবিবার, ৫ জুলাই, ২০১৫

আমার ব্রাদার আঁন্দ্রে উচ্চ বিদ্যালয়ের দিনগুলো-০২ঃ

আকাশে ঝলমল রৌদ্দুর। সবুজ ঘাসের উপর চকচকে রৌদের আলো-ছায়া খেলা। বাতাসে ফুলের গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে। চারদিকে উড়োউড়ি খেলা খেলছে প্রজাপতি আর ফড়িংয়ের দল। বাতাসের ঝাপটা আসছে মাঝে-মাঝে, সে ঝাপটায় ডানা মেলে পাখিরা উড়ে বেড়াচ্ছে কিচির-মিছির শব্দে। এর সাথে যুক্ত হল বিদ্যালয়ের সব ছেলে-মেয়েদের হৈ-হুল্লোর, হুড়ো-হুড়ি, চিৎকার।

বাড়ি থেকে আমাদের বিদ্যালয়ের অবস্থান দক্ষিন দিকে, তাই বিদ্যালয়ে প্রবেশ হতে গেলে আমাদের সবসময়ই বিদ্যালয়ের উত্তর গেইট দিয়ে প্রবেশ করতে হত। বিদ্যালয়ের উত্তর গেইট ছাড়াও দক্ষিণ দিক দিয়ে আরোকটি গেইট আছে।

বিদ্যালয়ের আঙ্গিনায় পা রেখে আমার কাছে বেশ ভালো লাগল। প্রথম গেইট পেরিয়ে গীর্জা, গীর্জার ধ্বনিত প্রার্থনা সংগীত, পাশে সানবাঁধানো পুকুর, সারি-সারি নারিকেল গাছ, দ্বিতীয় গেইটের পাশে ঝাউবন, ঝাউবনের শোঁ-শোঁ শব্দ, সবুজ ঘাস বিছানো বড় মাঠ, খোলা মাঠের উপর দিয়ে দখিনা বাতাস খেতে-খেতে শ্রেণীকক্ষে এগিয়ে যাওয়া। সত্যি সবকিছু যেন স্বপ্নের রাজ্যে পর্দাপন করার মতো।

দ্বিতীয় গেইট ফেরিয়ে আমরা যখন বিদ্যালয়ের বড় মাঠ দিয়ে বাতাস খেতে-খেতে এগিয়ে চলছি, তখন দিদিসহ অন্যসকল মেয়েরা দ্বিতীয় গেইট দিয়ে ডুকে ১৫-২০ হাত পূর্বে গিয়ে তাদের শ্রেণীকক্ষে চলে যাচ্ছে। আসলে বিদ্যালয়ে ছেলে-মেয়েদের আলাদা শ্রেণীকক্ষ হওয়ায় সবাই সকলের নির্দিষ্ট গন্তব্যে এগিয়ে যাচ্ছে।

তখন সকাল আটটা বাজে। আমদের বিশৃঙ্খল ছাত্রদের সুরুজ স্যার, হেলাল স্যার আর কামাল স্যার বেত হাতে শৃঙ্খলা বদ্ধ করতে লাগল। বেতে আমার ভয় সে ছোটবেলা থেকে। তাই বেত দেখেই শৃঙ্খল হবার দলে যোগ দিয়ে এগিয়ে গেলাম। প্রতিটি শ্রেণীকক্ষের সব ছাত্ররা দলবদ্ধ হলে, প্রতিটি সারি দলবদ্ধ হয়ে এগিয়ে যায় সবগুলো্ শ্রেণীকক্ষের বেষ্টনিতে ঘিরে থাকা মাঠে। যেখানে রয়েছে দন্ডায়মান স্বাধীন বাংলার লাল সবুজ পতাকা। বাতাসের ছটকায় যে পতাকা উড়ে চলছে মুক্ত আকাশে আপন খেয়ালে।

দন্ডায়মান পতাকার পিছনেই সকল শিক্ষক-শিক্ষিকাদের অফিস কক্ষ। কিছুক্ষনের মধ্যে হারমোনিয়াম আনা হল, অফিস কক্ষ থেকে বেরিয়ে অতুল স্যার হারমোনিয়াম ধরলে, তাঁকে মধ্যমনি করে পাশে এসে এক-এক করে দাঁড়াল প্রধান শিক্ষিকা ও অন্যান্য শিক্ষক-শিক্ষিকা ও দপ্তরী সকল। এবার সুরুজ স্যার এগিয়ে এলেন আমাদের ঠিক সামনে, দাঁড়ালেন আমাদের মুখোমুখি হয়ে। শুরু হল মার্চ ফাস্ট। মার্চ ফাস্টের পর শুরু হয় জাতীয় সংগীত। এ প্রথম আমি কারো মুখে জাতীয় সংগীত শুনে সবচেয়ে বেশী অভিভূত হলাম। মানুষ এত সুন্দর করে জাতীয় সংগীত গাইতে পারে, শ্রদ্ধেয় অতুল স্যারের সুরে না শুনলে আমি বোধ করি বিশ্বাসই করতে পারতাম না। জাতীয় সংগীত শেষে সুরুজ স্যারের সাথে আমরা সকলে দেশ তথা দশের কল্যানে নিজেদের বলিদান করবার শপদ বাক্য পাঠ করে সারিবদ্ধভাবে আবার নিজেদের শ্রেণীকক্ষের পথে এগিয়ে চললাম।

বুধবার, ১ জুলাই, ২০১৫

আমার ব্রাদার আঁন্দ্রে উচ্চ বিদ্যালয়ের দিনগুলো-০১ঃ

গোপাই স্কুলে পড়তাম আমি আর মেজদিদি (জয়ন্তী)। দিদি পঞ্চম শ্রেণী শেষ করে ষষ্ঠ শ্রেণীতে উর্ত্তীন হলে দিদির জন্য বিদ্যালয় পরিবর্তনের আভাস আসে, কেননা গোপাই স্কুল ছিল পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত। বাবা আর পরিবারের অন্যসকলে দিদিকে পরবর্তিতে বিনোদপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তির সির্দ্ধান্ত নিলেও মায়ের তাতে প্রচন্ড অমত ছিল। অতঃপর মায়ের ইচ্ছায় বাবা ও অন্য সকলে দিদিকে ব্রাদার আঁন্দ্রে উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তির অনুমতি দিল। কিন্তু এবার আমাকে নিয়ে ঝামেলা। যেহেতু তখন আমি তিনবোনের উপর এক ভাই ছিলাম, তাই ছেলের একা-একা বিদ্যালয়ে যাবার ক্ষেত্রে একধরনের ভয় মা অনুভব করতে থাকেন। অতঃপর বাবার ও অন্যান্যদের সাথে আলোচনায় ঠিক হল আমিও ভর্তি হব দিদির সাথে। যা হোক, যথাসময়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে ভর্তি তালিকা তৃতীয় স্থান নিয়ে উর্ত্তীন হলাম। যথাসময়ে মা আর দিদি গিয়ে ভর্তিও করিয়ে আসলেন। আমাদের দুই ভাইবোনের ভর্তি হবার সাথে সাথে ব্রাদারে আমাদের বাড়ির ছাত্র-ছাত্রী সংখ্যা গিয়ে দাঁড়াল পাঁচে। মানে শিশুশ্রেণী থেকে বিদ্যালয়ে পড়ত আমার বাবার কাকাত ভাইয়ের তিন ছেলে-মেয়ে (রানু দাদা, সংগীতা দিদি আর কানু) যারা সম্পর্কে আমার ভাইবোন।

নতুন বিদ্যালয়ের দিনগুলো কেমন হবে এ ভেবে খুবই উত্তেজিত ছিলাম আমি। কেননা; ছোটবেলা থেকে শুনে আসতাম ব্রাদার আঁন্দ্রে বেশ ভালো বিদ্যালয় এবং বিদ্যালয়ের আইন-কানুন বেশ কড়া। সুদেব আমাদের পাশের বাড়ির। পঞ্চমশ্রেণীতে ভর্তি হবার সুযোগে আমি তার সে সহপাঠী। তাই বাড়ি থেকে আর সকলের সাথে বের হলেও তার সাথে-সাথে হেলে-ধুলে পথ চলতে লাগলাম। নতুন বিদ্যালয়ে নতুন করে যাবার অনুভূতি তখন বোঝা যাচ্ছিল না ঠিক। ঠিক মনের মাঝে যেমন উৎচ্ছ্বাস ছিল তেমনি ছিল এক ধুরু-ধুরু কাঁপন। কেননা মাইর খাওয়ায় আমার ছিল দারুণ ভয়। সবচেয়ে বড় যে ব্যাপারটি তখন ছিল তা‘হল- বয়সের তুলনায় আমার শরীরের গঠন ততটা পরিপুষ্ট ছিল না। বড় কথা- আমাকে দেখে সকলে ঠিকরাত আমি বোধ করি প্রথম কিংবা দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ি। যা হোক, হেলেধুলে বিদ্যালয়ের আঙ্গিনায় পৌঁছলাম।