বৃহস্পতিবার, ৩ জুলাই, ২০১৪

কৌণার বাড়ি

বেশ কয়েক বছর আগেকার কথা। তখন প্রতিটি গ্রামের পরিবেশ বেশ মনোরম। মানে তখন গ্রামে বাড়ি-ঘরের এতটা ঘেঁষাঘেষি ছিল না, সবুজে চোখ জুড়ানো ক্ষেতে সকলের ভোর নামত আর সেখানে বসবাসরত লোকে‘রা বুর্জোয়া রাজনীতির “র” না জেনে সবুজ-সরল গাছের মতো দাঁড়িয়ে থাকত। পরম স্নেহ মমতা কিংবা ভালোবাসার সৌহার্দ্রে বেঁধে রাখা জীবনের গচ্ছিত গল্পগুলো তাদের ছড়িয়ে থাকত পার্শ্ববর্তী গ্রামের মানুষগুলোর সাথে। হেঁটে-হেঁটে তারা চষে বেড়াত চারপাশের সৌন্দর্য্য; সৌকত। তারা একে অন্যের বন্ধনে, আনন্দ শীহরণে, উৎসবে কিংবা পার্বণে ছিল পরমবন্ধু।

সে সময়ে গ্রামের বাড়িগুলোর নাম নির্দেশিত হত দিক, ক্ষমতা, শিক্ষা কিংবা শ্রর্দ্ধাজন ব্যক্তির নামে। তবে আশপাশের লোকেরা বলার ক্ষেত্রে দিকের উপরই বেশি নির্ভর করত। এই যেমন- বাড়ি পূর্বদিকে অবস্থিত হলে পূবের বাড়ি, পশ্চিমে হলে হইশমের বাড়ি উত্তরে অবস্থিত বাড়ি উত্তুরের বাড়ি আর দক্ষিণের বাড়ি দইনের বাড়ি। আমি এখন যে বাড়িটিকে ঘিরে ঘটনাটি বলব, সে বাড়িটিকে সকলে কৌণার বাড়ি নামে চেনে।

প্রথমে কৌণার বাড়ির সম্পর্কে কিছুটা ধারণা দেয়া প্রয়োজন। বাড়িটি পূর্ব-পশ্চিমের পাকা রাস্তার সাথে উত্তর-দক্ষিণে মিলিত হওয়া কাঁচামাটির রাস্তা দিয়ে বয়ে যাওয়া রাস্তার শেষপ্রান্তে অবস্থিত। পাকারাস্তা হতে বাড়ির অভিমুখে যেতে বামপাশে গাছ-গাছালি আর পুকুর ঘেরা বেশ কয়েটি বাড়ি আর ডানপাশে ক্ষেত, তারপর ধীরে-ধীরে এগিয়ে চলে কাঁচারাস্তার একেবারে শেষ মাথায় পৌঁছলে এসে পড়ে কৌণার বাড়ি। বাড়িটি মোটামুটি বড়সড়, বাড়িতে বসবাসরত আছে ৮-১০ টির মত পরিবার। বাড়ির চারপাশ গাছগাছালি ঘেরা, গাছ-গাছালির ঘেরা শেষ হলে তিনদিকেই ধু-ধু ক্ষেত ছাড়া আর কিছুই নেই। তাই বলা চলে নাম হিসেবে বাড়িটির সার্থকতা একেবারে উপেক্ষিত নয়।

যা হোক এবার মূল কথায় আসা যাক; বাড়িটির নাম কৌণার বাড়ি হওয়ায় নামটি দিনে-দিনে বাড়ির লোকজনদের সন্মানবোধের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এখানে অবশ্য আর একটা কথা বলে রাখা ভালো- যখন বাড়িটির নাম কৌণার বাড়ি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন বাড়ির লোকজন তেমন স্বাদ-সামার্থ্য ছিল না, ফলে তাদের কাছে বাড়ির নামের চেয়ে পেটের দায় ঠেকানো বড় ছিল। কিন্তু সময়ের সাথে-সাথে যখন লোকজনের অবস্থার পরিবর্তন হয়, লোকজন শিক্ষিত হয়, সামার্থ্যবান হয়, তখন শিক্ষা আর সামার্থ্যের সাথে সন্মান জড়িত থাকায় বাড়ির নামটি মূখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। তাছাড়া ছেলে-মেয়েদের বিয়ে দিতে গেলে কিংবা কোথাও বাড়ির পরিচিতি প্রদানে নাম বলতে গেলে একধরনের সংকোচবোধ কিংবা সন্মানবোধ টুটি চেপে ধরে! তাই বাড়ির সকলে একসাথে বসলেন ব্যাপারটার সূরাহার ব্যাপারে। সকলে মিলে সিদ্ধান্ত নিলেন, আশপাশের লোকজনদের নিয়ে একদিন বসে ব্যাপারটার একটা সূরাহা করবে। কারণ এটা জানা, যদি আশপাশের সকলের মুখ থেকে বাড়ির নামটি মুছে নতুন নাম প্রতিষ্ঠা করা যায়, তবে সত্যিকার অর্থে নামটি চিরতরে মুছে যাবে। কিন্তু বিপত্তি বাঁধল লোকজনকে কি বলে দাওয়াত দেবে সে নিয়ে? যদি বলা হয় বাড়ির নাম পরিবর্তনের জন্য দাওয়াত দেয়া হচ্ছে, তাহলে সকলের মাঝে বিষয়টি নিয়ে হাসি-ঠাট্টার শোরগোলের হবে। কিন্তু যদি সকলকে বুঝানো যায় ব্যপারটি, তাহলে কাজটি সহজতর হবে। তাই ঠিক হল বাড়িতে একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হোক, যাতে সহজে সবাইকে দাওয়াত দেয়া যায়। বাড়ির সকলের সন্মতিক্রমে তাই ঠিক হল। সময় নির্ধারণ করে আশপাশের দু‘তিন গ্রামের লোকজনদের দাওয়াত দেয়া হল।

নির্দিষ্ট দিনে সকলে অনুষ্ঠানে যোগদান করতে লাগল দলে-দলে। লোকজন অনুষ্ঠানে যোগদান করতে উপস্থিত হলে, বিভিন্ন গ্রামের মুরুব্বি, শিক্ষিত শ্রেণীকে নিয়ে ব্যাপার‘টার সূরাহার ব্যপারে বসলেন বাড়ির কর্তা। ব্যপার‘টা সকলের সামনে সুন্দরভাবে তুলে ধরা হলে সকলে তাদের সমস্যাটা বুঝতে পেরে মনে-মনে পীড়িত হল এবং সিদ্ধান্ত নিল বাড়িটির নতুন নাম প্রতিষ্ঠায় সকলে সাহার্য্য-সহযোগিতা করবে। সকলের সাথে আলাপ-আলোচনা শেষে নানান ব্যঞ্জণে অসাধারণ ভোজনের আয়োজন ছিল। বিভিন্ন গ্রাম থেকে আসা লোকজন মনভরে পেটপুরে খেয়ে একে-একে নিজেদের গন্তব্যে ফিরে যেতে লাগল। বাড়ির কর্তা তিনি আগত লোকজনের যেন কোনপ্রকার সমস্যা না হয় সেজন্য সূচারুরূপে সবদিক দেখভাল করতে লাগলেন। অনেকক্ষন সকলের খায়-খাতির করে তিনি বাড়ির কৌলাহল ছেড়ে বাড়ির প্রবেশের মূল রাস্তায় বেরিয়ে এলেন একটু মুক্তবাতাস নিতে। আর যা হোক, এভাবে এতবড় একটা আয়োজন সে ত কম কথা নয়। মুক্তবাতাস নিতে এসে তিনি দেখতে পেলেন আগত অতিথিরা খেয়ে-দেয়ে এক-এক করে ফিরে যাচ্ছে। সকলের চোখে-মুখে পরিপূর্ণ তৃ্প্তী। এ দেখে তিনিও তৃপ্ত হলেন। হঠাৎ এক পথচারী এতগুলো লোককে এভাবে বেরিয়ে যেতে দেখে কৌতুহলবশত জিজ্ঞাসা করলেন। আপনারা সকলে কোথা থেকে আসছেন? লোকজন কোনপ্রকার দ্বীধা-সংকোচ না করে সহজ-সরল জবাব দিল কৌণার বাড়ি থেকে। কথাটা শুনেই বাড়ির কর্তার চোখমুখ হতে আগুনেররশ্মি বিচ্ছুরিত হতে লাগল, একটু আগের উজ্জ্বল আন্দোলিত হৃদয়ের অনুভবের মন ফ্যাকাশে হয়ে গেল। কিন্তু উপস্থিত পথচারির সামনে ফিরে যাওয়া অতিথিদের কথায় প্রতিবাদ করার সামার্থ্য তিনি পেলেন না।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন