বুধবার, ৫ জুন, ২০১৩

স্মৃতিচারণঃ একদিনের কল্পবিলাস পার্বণের আমন্ত্রনে


জীবন থেকে অনেক কিছু চলে যাচ্ছে চলে যাবে, কেননা জীবন যে বড়ই সঙ্গীন। ভালোবাসা জনে-জনে ভিন্ন হয় দিনে-দিনে গাঢ় হয়। কিন্তু একি? গাঢ় ভালোবাসার যে এখন গলনাংক কমে যাচ্ছে আর দিনকে-দিন তা শূণ্যের কৌঠায় পৌঁছে যাচ্ছে। আচ্ছা ভালোবাসার গলনাংক যখন শূণ্যে গিয়ে দাঁড়াবে তখন কি মানুষ ভালোবাসায় এঁটে যাবে? মানে- সবকিছু একত্রে জড়ো হয়ে যাবে?


বড় বেসরিক বকছি; কেহ কেহ ইতিমধ্যে পাগল ঠিকরাতে শুরু করেছে হয়ত। কিন্তু কেন জানি ভায়া, আমার না সত্যি তাই বোধ হচ্ছে। এই দেখ না বিজ্ঞানের উৎকৃষ্ট সাধনে আজ আর ভোরের আলোয় মাঠ কর্মচঞ্চল হয় না, সোনাজাদুদের বুকের কাছে জড়িয়ে বাবা-মায়েরা শুয়ে থাকে। কিন্তু জাদু উঠেছে বলে তার নাস্তায় ব্যস্ত হয়, বাবা ব্যস্ত হয় জাদুর সাথে নাস্তা করতে। প্রযুক্তির ছোঁয়ায় সব হয়ে যাচ্ছে, তারপরও কানে ভাসে, উহ! এত কাজ একজনের পক্ষে করা সম্ভব? সাথে-সাথে অনেকে আবার ভালোবাসায় উচ্চারণ করে, আমি তোমার কষ্ট বুঝি; এই ত আর মাত্র কয়টাদিন তারপর সব ঠিক হয়ে যাচ্ছে। ঘরের গৃহিণীর এখন ঘরের কাজেও একজন সহকর্মী লাগে; আহা! এমন দুধে-আলতা গৃহিনীর ছুড়িয়ে পড়া রং এতশ্রমে যে, ছুকিয়ে যাবে।

অথচ যখন ছোটবেলায় পৌঁছুই তখন দেখী ভোরের আভা ফুঁটেছে কি ফূঁটে নি তখই কর্মচঞ্চল সকলে, আহারে-বিহারে কিংবা নাঙ্গলে-জোয়ালে। অবুঝ হৃদয় কি তখন এতটা বুঝত? শুধু অনুভব হত বেশ, এই বাবার সাথে বসে যদি সকালের নাস্তাটা হত কিংবা মা যদি একটু মুখে তুলে দিত; বড় সুখী মনেই সকালের নাস্তাটা আমার হয়ে যেত। কিন্তু ভালোবাসা যে; তখন আর উত্তরিয়ে পড়ত না, তাই আশাটাকে নিজের মধ্যে দাহ করে দিতাম কিংবা আবেগের আহত চিৎকারে চঞ্চল করে তুলতাম মায়ের মমতার হৃদয়কে। ঘরে বসে বাবার সাথে সে নাস্তা না হোক, মাঠে গিয়ে বাবার নাস্তাটুকু ভাগ পেয়ে কিছুটা ভালোবাসায় সিক্ত হতাম। প্রকৃতিকে দেখিয়ে-দেখিয়ে নাস্তা করতাম আর বলতাম, এই আমার বাবা আমাকে কত্ত ভালোবাসে। কিন্তু ভালোবাসায় সিক্ত কোমল হৃদয় তখন বুঝত না; মমতায় আমার অর্ধাহারি বাবা আমাকে কি দিয়েছে আর আমি তাকে কি দিচ্ছি।

দিনরাত্রি বাবা-মায়ের সান্নিধ্যে রঙ্গিন স্বপ্নরা মুছে গেলেও কর্মে দূর্ভোদ্য জীবনে কিছুটা ভালোবাসার হিমবাতাস নেমে আসত মাঝে-মাঝে। আরে ঐযে; মনে পড়ছে না……. নানান পূজা-পার্বণের কথা? হ্যাঁ; তখন আমাদের জীবনের যেটুকু ভালোবাসার রঙ্গিন শুভেচ্ছা ছিল সে পূজা-পার্বণের কালে। আনন্দগুলো বেশী ঘটা করে আসত পহেলা বৈশাখ আর কোজাগরি(লক্ষ্মী) পূজায়। মনে পড়ে কোজাগরের সে দিনে বাড়ীর আশপাশে দাদাদের কিংবা কাকাদের অগ্রীম বাজী ফুটানোয় সে কি বাসনা জাগ্রত হত। কেঁদে-কেঁদে অস্থির করে তুলতাম মা-বাবাকে। বাবা আমাকে যে এবার বেশী করে বাজী কিনে দিতে হবে। বাবা ভুলাতে চেষ্টা করতেন, বলতেন বাজী কিনে আগুণ ধরালেই তো শেষ, তারচেয়ে বাবা তোর জন্য মজার-মজার খাবার নিয়ে আসব। কিন্তু মজার খাবার কি আর পারে লুটতে হৃদয়ের গভীরে পোথিত বাসনাকে। খাবারের লোভ যখন নগণ্য তখন এমন বোঝানোয় আরো অস্থির করে তুলত। কান্নারাও তখন আরো জোরালো হত। অবশ্য মা বলত, কি করছ, ছেলেটাকে কিছু বাজী কিনে দাওনা- “মানুষের জীবনে শখ বেশী নাকি পাঁচ শিকে বেশী”? মায়ের কথায়ও যখন দেখতাম বাবার মুখ দিয়ে আশ্বাসের কোন বাণী নিঃসরিত হচ্ছে না, তখন বড় অভিমান হত। ভাবতাম বাবারা কোনদিনও ভালোবাসতে জানে না। তখন পদে-পদে অনুভব হতো ভালোবাসার শূণ্যতাকে, মা-বাবা কিংবা স্বজনদের অমানুষিক পরিশ্রমে যখন গা দিয়ে ঝর-ঝর করে ঘাম নিঃসরণ হত, তখন সব কিছুতেই বড় বেশী অমানুষিকতা বোধ হত। বার-বারই আক্রান্ত হৃদয়ে উৎসরিত হত- ক্ষুধার যাতনায় ভালোবাসারা বোধহয় মারা পড়ে।

আজ জীবন অনেক ভালোবাসাময়। সত্যি এখনকার ভালোবাসার বর্ণন বড়ই সুকঠিন। কিন্তু এত ভালোবাসাও আজ বড় অনুভব হয় ভালোবাসার তারতম্য‘তা, হৃদয়ের পীড়ণে জমে থাকা স্মৃতিপটে আহত হয় আজকের হৃদয়। হায়! আমি আর কি ফিরে পাবো সে মূর্তিমান দিনগুলি; যেখানে হাজার দুঃখ-যন্ত্রনাও নিঃশেষ হতে চাইত একদিনের কল্পবিলাস পার্বণের আমন্ত্রনে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন