মঙ্গলবার, ৫ নভেম্বর, ২০১৩

বিদ্রুপের হাসি

[ঢাকা শহর।কত জানা-অজানার সংমিশ্রন, কত সংথৈব দুঃখ-কষ্টের পদচারনা, কত নিয়তির দীর্ঘশ্বাস, কত যুদ্ধ-সংঘাত, কত আহুতির পরিসর আর তার মধ্যে আবার কত দালান-কৌঠা, গাড়ী আর পাপের বিস্তৃতি।আর সেসবের দু্'একটার প্রকাশ আমার বাস্তব জগত।-অবিবেচক দেবনাথ।]
এখনো কচিমুখের চাপ কাটেনি মুখ থেকে অথচ সংসারের দ্যৌটানা নামিয়ে নিল পথে। দেখে হতবাক হই, সংসারের হাল ধরতে এই বয়সে ওদের প্রচেষ্টা। নিজেদের ভবিষ্যত নিয়ে ওরা ভাবিত নয়, ওদের প্রচেষ্টা শুধু জীবনের প্রতিটি ধাপ যুদ্ধ করে টিকে থাকা। ঢাকা শহরের পথে-ঘাটে, অলিতে-গলিতে চোখ পড়ে এমনি কত কচি ছেলে-মেয়ের, যারা সংসারের দুঃখ-কষ্ট ঠেকাতে নেমেছে পথে। চলছে জীবনের বাস্তবতার সন্মুখিন যুদ্ধ করে।
আমার এই লেখা এমনি এক কচিমুখ নিয়ে, যার এখন মাঠে-মাঠে ছুটে বেড়ানোর কথা, যার জ্ঞান আরোহনের জন্য বিদ্যালয়ে উপস্থিত থাকার কথা। কিন্তু; ভাগ্যের পরিহাসে পথে-পথে তার খেলাধুলা চলে কর্মের মাধ্যমে।আর কর্মের মধ্যেও ঘটে কষ্টের সন্নিবেশন, এ যেন তার প্রতি পদক্ষেপের হৌঁছট এবং ভাগ্যের বিরূপ-প্রতিরূপ।

 এই ঘটনাটি আমি প্রত্যক্ষ করি ২০০৮ ইং সালের আমি তখন গুলশান-২ এ অবস্থিত অতীশ-দীপঙ্কর বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের ছাএ ছিলাম তখন।ক্লাস শেষ করে আমি হেঁটে-হেঁটে আমার নতুনবাজারের বাসায় ফিরছি। আমি যখন বারিধারা কোরিয়ান অ্যাম্বাসি থেকে বিশ কি ত্রিশ কদম দূরে, তখন দেখলাম ১১-১২ বছরের একটা ছেলে হেলেধুলে গুলশান-২ এর দিকে আসছে।তার ডানহাতে একটা বড় ফ্ল্যাক্স আর বামহাতে একটা বালতি। ছেলেটিকে দেখেই বোঝা যাচ্ছিল এই বয়সে সে চা বিক্রি করে সংসারের হাল নিজের কাঁদে তুলে নিয়েছে আর এ বয়সেই তার মাথায় ডুকেগেছে সংসারের অন্ন-বস্ত্র জোগাড় করতে তাকে শ্রম দিতে হবে।তার কাছে এই স্পষ্ট জীবনবোধ মনে হয়না কারো শেখানো, প্রকৃতি যেন তাকে শিখিয়ে-পড়িয়ে চালিয়ে নিচ্ছে।হেলেদুলে ছেলেটি কোরিয়ান অ্যাম্বাসি পার হল মাত্র, আমিও তার কাছাকাছি প্রায়।ছেলেটির এই হেলেদুলে হেঁটে চলা আমার ভালো লাগল, আমি তাই তাকে প্রত্যক্ষ করে হাঁটছি সামনের পথে। হঠাৎ ছেলেটির এগিয়ে আসা থেমে গেল, আমিও স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম।ছেলেটি নির্বাক হয়ে পথের উপর চেয়ে আছে , আমার ও চোখ পথের উপর। নির্বাক অবস্থান আমাকেও ছুঁয়েছে।আমি দেখলাম পথে ছড়িয়ে-চিটিয়ে পড়ল ভাত, দুই টুকরা আলু, ছোট এক টুকরো জাটকা মাছ, টুকরো হয়ে যাওয়া কাঁচের তিনটি পেয়ালা,একটি টিফিন বাটি ও প্লাষ্টিকের বালতিটি। ছেলেটির হেলেধুলে চলতে গিয়ে হাতথেকে ছটকে পড়েছে বামহাতের বালতিটি।ছেলেটি স্থির যন্ত্রের মতো দাঁড়িয়ে রইল। তার চোখেমুখে জ্বলে উঠল অনাকাঙ্খিত ব্যাথার অনল। আমি এগিয়ে এলাম তার কাছাকাছি, তাকালাম তার মুখের পানে, চেষ্টা করলাম তার মনটাকে বুঝতে তার মুখের দিকে তাকিয়ে।আমার মনে ফুটে উঠল অপষ্ট এক ব্যাথা। আমিও যেন বাকরুদ্ধ হলাম আজানা হৃদয়ের অন্তঃক্ষরনে। আমি তাকে কিছু জিঞ্জাসা করিনি, করার সাহসও হয়নি আমার। কেননা আমি যে, বাস্তব জগতে তার কষ্টের অংশীদার হতে পারবনা। আমিও যে অন্যের করূনায় জীবনধারন করে চলছি।ছেলেটি অনেক সময়পর আমার দিকে তাকিয়ে অস্পষ্ট একটা হাসি দিল।আমি জানিনা এই হাসির রহস্য। এ হতে পারে নিজের কষ্ট ও লজ্জা গুছানোর হাসি, হতে পারে ফাঁটা কপালের রক্তক্ষরনের হাসি অথবা নিজের দূর্বিসহ নিঃশ্বাসটাকে ঠেকানোর হাসি।
আমি কোন কিছু জিঞ্জাসা না করেই এবং ছেলেটিকে কোন প্রকারের সান্তনা না দিয়েই আমার গন্তব্যে হাঁটতে লাগলাম। আমি নিজের কর্তব্যের প্রতি নূন্যতম সৌজন্যবোধ রাখিনি, কেননা আমি জানি আমি এতটা আবেগ প্রবনযে, ওর মুখের দ্বিতীয় শব্দটি আমাকে পুড়িয়ে নেবে বেশ কিছুদিন। তাই নিজেকে রক্ষা করতে চোখ বুজে সামনে এগিয়ে গেলাম।ছেলেটির অবস্থা মনে করে আমি বিদ্রুপের হাসি হাসলাম, আর বিধাতাকে অভিযোগ করলাম, এই ও তুমি কর প্রভু? এই বয়সে ছেলেটিকে তুমি এমন করে পরীক্ষা করতে পারছ? ছেলেটি কি এর ফল বইতে পারবে?

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন