মঙ্গলবার, ৫ নভেম্বর, ২০১৩

মুক্তির ক্ষুধা

সে অনেকদিন আগেকার কথা, এক বনে ছিল এক দুষ্ট বাঘ, তার হিংস্রতায় ছিল বনজীবন ও জনজীবন অতিষ্ট। একদিন এক দুষ্ট শিকারীর ফাঁদে ধরা পড়ে খাঁচায় বন্দি হয় বাঘটি। ফলে বনজীবন ও জনজীবনে নেমে আসে সুখের বারতা।
এভাবে কিছুদিন কেটে যায়, দিনের পর দিন খাবারের অভাবে বাঘটি ক্ষুধার্ত ও ক্লান্ত হয়ে পড়ে এবং পথিমধ্যের লোকজনকে আকুতি-মিনতি করে তাকে ছেড়ে দেবার জন্য। কিন্তু দুষ্টবাঘের ব্যাপারে সবাই জানত বলে কেউ তাকে ছেড়ে দিতে রাজি হয়না। শেষে এক সহজ-সরল লোক বাঘের মায়াকান্নার মোহজালে ধরা পড়ে বাঘটিকে ছেড়ে দেয়। অবাক ব্যাপার হল বাঘটি বেরিয়ে এসে লোকটির উপর কৃতজ্ঞতা স্বীকার না করে ক্ষুধার তোপে তাকে খেতে ছুটে যায়। অনেক অনুনয়-বিনয় করেও লোকটি বাঘটির হাত থেকে বাঁচার উপায় খুঁজে পায় না। পরিশেষে ধূর্ত শিয়াল পন্ডিতের বুদ্ধিতে লোকটি প্রানে রক্ষা পায়।
উপরোক্ত গল্পটি লেখার জন্য এবং সমাজের দিকে বারংবার আঙ্গুলি তুলে সত্যতাকে আমাদের বোধগম্যতায় পৌঁছে দেবার জন্য গল্পকারকে অসংখ্য ধন্যবাদ। গল্পকার এই গল্পের মধ্যে জনজীবন ও বনজীবনকে একত্রিভূত করে সমাজের চোখে আঙ্গুলি তুলে সমাজকে কতটুকু দৃষ্টিপাত করাতে সক্ষম হয়েছেন তা আমার বোধগম্যতার বাহিরে, আমার বিশ্বাস গল্পকার এখানে হিংস্রবাঘের আড়ালে হিংস্র মানুষকে বুঝিয়েছেন। কারণ মানুষ আর হিংস্রবাঘটির মধ্যে পার্থক্য শুধু মনুষ্যত্ববোধের, যা হারালে মানুষ আর পশুর মধ্যে কোন পার্থক্য থাকে না।
বাংলাদেশ একটি নামভুক্ত গণতান্ত্রীক রাষ্ট্র। যেখানে সরকার গঠন করে দু’দল হিংস্রজানোয়ার। এদের একদল যখন ক্ষমতায় অসিন থাকে অন্যদল তখন খাঁচায়। ক্ষুধায় তখন খাঁচার জানোয়ারগুলো ছটফট করতে থাকে, লাফালাফি আর ছুটাছুটি করতে-করতে দূর্বল হয়ে তারা জন-সাধারণের কাছে করজোড়ে অনুনয়-বিনয় করতে থাকে। আর মুক্ত জানোয়ারের দল ধরপাকড়া দিতে থাকে রক্ত আর মাংসের স্বাদে। করতে থাকে হত্যা, রাহাজানি, লুটপাট, অরাজকতা, ধর্ষনসহ নানা অপকর্ম। আর আমরা যারা অতিসাধারণ, যাদের ইচ্ছে সুখে একবেলা একমুঠি খেয়ে ক্ষুধা নিবারণ করে বেঁচে থাকার, তাদের জীবন হয়ে পড়ে অতিষ্ঠ, আতঙ্কিত। তাদের কাছে আমাদের বেঁচে থাকাটাই যেন বোঝা ঠেকে, যেন অভিশাপে অভিশপ্ত হয়েছি তাদের মুক্ত করাতে। অনেক অনুনয়-বিনয় করেও আমরা তাদের কাছে কৃতজ্ঞতার বদ্যৌলতে আমাদের জীবন-সংসার রক্ষার্থে ব্যর্থ হই। তারা ভুলে যায় এই আমাদের জন্যই তাদের মুক্তি, তাদের স্বস্তির নিঃশ্বাস।
-আমরা কোথায় যাব? কোথায় পাব আমরা সেই ধূর্ত শিয়াল পন্ডিতকে যে আমাদের রক্ষা করবে?
-ওহ! দুঃখিত। আমাদের একদল শিয়াল পন্ডিতও আছে, যারা সমাজের বিবেক। যাদের মতাদর্শে আমরা নিজেদের গড়ে তুলব। তারা কি আমাদের রক্ষা করবে?
-আহা, কিযে বলেন, কিভাবে তা করবে তাঁরা? তাঁরা আজ নিজেরাই তো স্তব্ধ, আতঙ্কিত। তাঁদের বুদ্ধিশিখা নিভে গেছে তেলের অভাবে। তাঁদের কলম নীরব হয়ে গেছে কালির অভাবে। তাঁরা নিজেরাই আজ শস্যফুল দেখতে পান চোখে। ভীত-তত্রস্থতায় তাঁরা বীরের পোশাক ছেড়ে চোরের বেশে রাতের অন্ধকারে চলাতেই এখন বেশী স্বাচ্ছন্দবোধ করেন ও নিরাপদ ভাবেন। তাই এখন পথে-পথে উপচে পড়ছে তাদের উপদেশ বাণী, শান্তনার ধ্বনি।
-হায়রে, এই আমার সমাজ! এই আমার দেশ! এই আমার বিবেক! শুধু রূদ্ধনিঃশ্বাস ছাড়া ফেলার মতো আমাদের কাছে কি আর কোন অবশিষ্ট আছে?
-এই দেশ, এই মমতা, এই স্বাধীনতার স্বাদ গ্রহণ করতে এ জাতি এতটা রক্ত ঢেলে দিয়েছি?
অবাক লাগে! সত্যি, অবাক লাগে। কি প্রয়োজন ছিল এমন স্বাধীনতার? কিসের আশায় আমাদের মা-বাবা, ভাই-বোন আর আত্মীয়-স্বজনরা অগ্নির দহনে পতঙ্গের ন্যায় নিজেদের সমাহিত করেছেন?
আজ কান্নার বাঁধ মানেনা, এই কলংক আমরা কোথায় ঘুচাব? সত্যি যদি চিরজীবন সত্যিই হয়ে থাকে, তবে কোন অধঃগতির প্রত্যাশায় আমরা বসে আছি অথবা কোথায় হতে মিটবে আমাদের মুক্তির ক্ষুধা?

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন