রবিবার, ২০ এপ্রিল, ২০১৪

জীবন থেকে শিক্ষা-০১

প্রতিদিনকার মত আজও ফার্মগেইট দাঁড়িয়ে আছি গাড়ীর আশায়। গাড়ীতে লোকের ভীড় সে নিত্যদিনকার, তাই ভীড় ঠেলে যাওয়া-আশাই আমাদের নিত্যদিনকার নিয়তি। মাঝে-মাঝে যখন ভীড় ঠেলতে হচ্ছে হয় না, সেদিন অবসন্ন মুখেই রৌদে ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকতে হয়ে। আমজনতার জ্যাম গাড়ী হলেও স্টাফবাস নামকার সরকারী বাস প্রতিদিনই প্রায় ফাঁকা যেতে দেখি, চাইলেই তারা আমাদের আমজনতার মুষ্টিমেয় লোক টেনে নিতে পারে কিন্তু তা তাদের সামার্থ্যের মধ্যে নয় বলেই বোধহয় আমজনতার কষ্টেও তাদের সমূহ দৃষ্টি অনিবার্য নয়। যা হোক; প্রতিদিনকার মতোই দাঁড়িয়ে ছিলাম। হঠাৎ একটা মাইক্রো এসে সামনে দাঁড়াল, দেখলাম লেখা আছে শিল্প ও সংষ্কৃত মন্ত্রণালয়। হ্যাঁ; গাড়ী দাঁড়াতেই পারে, কারণ তাদের স্টাফ‘রা বিভিন্ন জায়গা থেকে গাড়ীতে ওঠে, হয়ত কোন স্টাফ উঠবে বলে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু না, কিছুটা হতবাক করে দিয়ে ড্রাইভার আমার মতো আমজনতাকে আহ্বান করল; আমরা কেউ পল্টন বা দৈনিকবাংলা যাব কিনা। আমি পল্টন যাব, তাই ড্রাইভারের আহ্বানে জানতে চাইলাম ভাড়া কত দিতে হবে? কারণ, আমি আমজনতার পকেটও যে হিসেবের। ড্রাইবার কিছুটা হতবাক করে বলল; আপনারা যা দেন, না দিলেও সমস্যা নেই। ড্রাইবারের অভয় পেয়ে উঠে পড়লাম ড্রাইভারের পাশের সিটটায়। পেছনে তাকালাম দেখলাম দু‘জন সরকারী কর্মকর্তা, যাদের জন্য হয়ত এই গাড়ী বরাদ্ধ। দু‘জনের একজন লেফটপে কি যেন করছেন, অন্যজন দেখে-দেখে গল্প করছেন। যাই হোক আমরা পাঁচ আমজনতা তাদের অনুগ্রহে সরকারী মাইক্রোতে ওঠার সৌভাগ্য লাভ করলাম।

গাড়ী চলতে শুরু করলে কর্মকর্তাদের একজনই কথা তুললেন, প্রতিদিন কতগুলো স্টাফবাস খালি-খালি যায় অথচ সাধারণ মানুষের কষ্টের সীমা নেই, তার সাথে গলা মিলিয়ে এক আমজনতার বয়োজ্যোষ্ঠ ভদ্রলোক বললেন তারা যদি এমনটি করত তবে সাধারণের অনেক উপকারই হত, কারণ আমাদের জন্য যে গাড়ী আছে, অফিসের সময়ে তার পরিমান অপ্রতুল। সরকারী কর্মকর্তা বললেন আসলে সে নেয়া যেত কিন্তু মাঝে-মাঝে নাকি, চুরি-ডাকাতি হয়, তাই-
বয়োজোষ্ঠ ভদ্রলোক বললেন কি বলবেন এখনকার লোকজনদের স্বভাবও নষ্ট, দেখা যায় তারা গাড়ীতে উঠে বিশৃঙ্খলা করে, যে কারণে পাবলিক গাড়ীগুলোতে তাদের নেয়া হয়না- ওই যে বলে না; অভাবে স্বভাব নষ্ট, আসলে দেশের হাজার-হাজার বেকার তাদের নাই চাকরি-বাকরি, তাই বাধ্য হয়ে তারা অসৎ কার্য্যে পা বাড়ায়। তার কথায় দ্বিমত পোষন করে সরকারী কর্মকর্তা জানালেন, ভাই অভাবে নয়, অভাবেই যদি সকলে অসৎ কাজে পা বাড়াত; তবে মন্ত্রী-এমপিদের এই বেহাল দশা কেন? ঠিক কি অভাবে তাদের এই নষ্ট স্বভাব? পৃথিবীতে এমন অনেক দেশ আছে যাদের অনেক সমস্যা থাকতেও তারা সববিষয়ে পারস্পরিক সমদর্শি। যাই বলেন না কেন; শুধু নিজের স্বার্থের প্রতি লোলুপ দৃষ্টি থাকলে এই হবার কথা। আমি সরকারী কর্মকর্তার সাথে একমত পোষন করলেও কিঞ্চিৎ ভিন্নতা পোষন করি, আমার মনে হয়; এ নৈতিক অবক্ষয় বা চারিত্রিক দৃড়তার অভাব, কারণ প্রকৃতি মানুষের সামনে ভালো-মন্দ দু‘টোই রেখেছে, যে মন্দটাকে মন্দ জেনেও তাকে আকড়ে ধরে রাখতে চায়, সে নৈতিক অবক্ষয়ের শিকার, সে সমাজ বুঝে না, দেশ বুঝে না, তার কাছে নিজের ক্ষমতা সংরক্ষণই অভিসম্ভাবী কর্তব্য হিসেবে পরিগণিত হয়। নিজের মনের কথাগুলো নিজের মনেই আওরাই, সকলে বয়োজ্যোষ্ঠ বিধায় কিছুই বলার সাহস মেলে না। যাই হোক; তাদের কথাই শুনছি। সরকারী কর্মকর্তা মন্ত্রী-এমপিদের প্রসঙ্গ টানতেই বয়োজোষ্ঠ ভদ্রলোক বললেন- আসলে মন্ত্রী-এমপিদের অবস্থা এমন হবার কারণ, আমরা একটা গল্প পড়েছিলাম ছোটবেলায়, সে হল একটা ইদুরকে বড় করতে-করতে বাঘ করা হল। কিন্তু তাতেও তার ঘরকাটা বন্ধ হল না। আর আমাদের মন্ত্রী-এমপি‘রা হল তাই; যারা বাস্তবিকই ইঁদুর, ঘরকাটা বা অনিষ্টই যাদের স্বভাব। এদের যতই ফুলিয়ে বাঘ বানানোর চেষ্টা করা হোক না কেন তাঁদের স্বভাব যে ইঁদুর হয়েই থাকা।

সরকারী কর্মকর্তা আবার বললেন- দেখুন আপনারা কয়জন আমাদের সাথে যাচ্ছেন, তাতে আমাদের কি এমন ক্ষতি হচ্ছে? অথচ এই বিষয়টি কাউকে বোঝানো সম্বব নয়, এও যে একধরনের উপকার। বয়োজোষ্ঠ লোকটি বললেন অবশ্যই এ উপকার, কিন্তু সত্য কি জানেন আমরা উপকারের প্রতিদান দিতে তো জানিই না, উল্টো উপকারীর ক্ষতি করে থাকি। বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না; আমি আমার জীবনে অনেকের উপকার করেছি, কিন্তু শতকরা ৯৯ ভাগই আমার ক্ষতি করেছে। সরকারী কর্মকর্তা বললেন-সে ঠিক আছে, বেশিরভাগই উপকার পেয়ে ক্ষতিই করে। তবে এও সত্য লাভের আশায় বা বিনময়ের আশায় উপকার করার মানষিকতা না রাখাই শ্রেয়। বয়োজ্যোষ্ঠ লোকটি কিছুটা আমতা-আমতা করে বললেন- সে ঠিক, সে ঠিক। ধরুন আমার ছোটভাই যদি আমার ক্ষতিও করে থাকে তবে কি আমি তার বিপদে দাঁড়াব না, বিনিময়ের আশায় আমাদের কারো পাশে দাঁড়ানো চিন্তা করা ঠিক নয়। এতেই আমরা এক অপরের হীতকল্যানে কাজ করতে পারব। যা আমাদের দেশের জন্য হীতকল্যান বয়ে আনবে। হ্যাঁ আমিও তাই মনে করি- যদি অন্যের কাছ থেকে কিছু পাবার আশায় উপকার করা হয়, তবে সে স্বার্থপরতা। আর কারো উপকারে নিজের ক্ষতির সম্ভবনা ১০০ ভাগ নিশ্চিত, তাই আমি মনে করি এই নিশ্চিত বিষয়টিকে শীরোধার্য্য ভেবেই সকলের উপকারে নিজেকে নিয়োজিত করা উচিত।

সককারী কর্মকর্তা বললেন- উপকার করতে গেলে ক্ষতিগ্রস্থ হবার সম্ভবনা যেহেতু থাকে, তাই নিজের অবস্থানটুকু সবসময় শক্তিশালী রেখেই উপকার করা শ্রেয়, এতে কষ্ট পাওয়ার সম্ভবনা কিছুটা প্রশমিত হতে পারে। বয়োজ্যোষ্ঠ লোকটি এবার বললেন- তবে জানেন কি, উপকার করলে শত্রু বৃদ্ধি পায়। আমার এক বন্ধু আছে যার কোটি-কোটি টাকার মালিক। সে কখনো কারো উপকার করে না, সে বলে কি জানেন? সে বলে দেখ বন্ধু আমি যদি আজ কারও উপকার করি তবে দু‘চারদিন পর আরও নতুন কেউ আমার শরণাপন্ন হবে, আর এভাবে শরণাপন্ন হওয়ার লোক বাড়তে থাকলে আমি যখন কাউকে কিছু দিতে অসমর্থ হব, তখন আমার শত্রু তৈরী হবে। আমি চাই না আমার কোন শত্রু তৈরী হোক। সরকারী কর্মকর্তা বললেন ভাই এভাবে চিন্তা করলে তো পৃথিবীতে কেউই কারো উপকারে আসবে না, আল্লাহ আমাদের পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন সকলের উপকারের জন্য, আমরা যদি এভাবে ভাবি পৃথিবীতে সুখ আসবে কি করে? বয়োজ্যোষ্ঠ লোকটি এবার বললেন সে ঠিক আছে। আমাদের কিছু না পাবার আশা করেই সকলের উপকার করা উচিত, যেমনটি আমরা আমাদের পরিবার পরিজনের জন্য করে থাকি।
কথা শুনতে-শুনতে আমার গন্তব্যে চলে এলাম, নামবার সময় ড্রাইভারকে ভাড়া ১০টাকা দিলাম, ড্রাইভার নিতে চাইছিল না, তবু তার ন্যার্য্য ভাড়া দিয়ে তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে অফিসের পথে পা বাড়ালাম। আর আলাপচারিতাগুলো মাথায় জমা রাখলাম।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন