রবিবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

ক্ষমতা আর জীবন

চোখ রগাড়াতে-রগাড়াতে টকটকে লাল হয়ে গেছে, অনিয়মিত খাওয়া আর অপর্যাপ্ত ঘুমের কারণে চেহারার জলুস ভাঙ্গা শরীরের শীরদাঁড়াগুলো স্পষ্ট চোখে লাগছে। তবুও পেটের দায়ে আজ পথে নেমেছে ৬০ উর্দ্ধ বিনয় দত্ত। সারাদিন এধার-ওধার খুঁজে হয়নি তার আহারের ব্যবস্থা। চলার সামার্থ্য নেই তবু পরিবারের দায় বয়ে সংকোচে-সৌহার্দ্রে ফিরতে পারছে না। ঘরে যে পড়ে আছে তার জন্মান্তরের বন্ধিনী স্ত্রী মানষী, অকালে যৌবন খুইয়ে মরা ৩০ উর্দ্ধা একমাত্র কন্যা নীরা।

লজ্জায়; শারীরীক দূর্বলতায় পথ চলে না তার, তবু সংকুলান বুঝে না মনের শক্তি। বিকেল ঘনিয়ে এলে শ্রান্ত দেহ তার এলিয়ে পড়ে পথের কদম গাছতলায়। চোখ ভেঙ্গে আসে কিন্তু ঘুম আসে না, দিনভর কোন ভয়, হতাশা, বিষন্নতা তাড়িয়ে বেড়ায়। ঠিক তখনই দু‘চোখ ভিজে যায় অতীত স্মৃতির মূর্চ্ছনায়। বিনয় দত্তের মনে আসে সে দিনগুলোর কথা। দেশান্তরি হবার আগের দিনগুলোর কথা।
বিনয় দত্তের জন্ম বাংলাদেশে, পারিবারিকভাবে জন্ম থেকেই সে সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান। বাবার বিশাল সম্পতির মালিক। ফল, ফুল, পাখির কিচির-মিচির ঘেরা বাগান বাড়ি ছিল তার। স্ত্রী-কন্যা, চারপাশের আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে ভালোই দিন কাটছিল তার। কিন্তু কি থেকে কি হল? হঠাৎ করেই গ্রামের ক্ষমতাশালী কতিপয় ক্ষমতাসীনের কাছে তার অবস্থান কাঁটা হয়ে দেখা দিল। তারা ছলে-বলে-কলে-কৌশলে তাকে বাঁধা দিতে লাগল। তার একমাত্র কন্যা নীরাকে পথে-ঘাটে অপদস্থ করতে লাগল। উপায়ন্তু কিছু না পেয়ে তিনি আশপাশের বন্ধু-বান্ধবদের সাহায্য পেতে চেষ্টা চালালেন। কিন্তু ক্ষমতাশালীদের কাছে কোন সাহার্য্যই টিকল না। হঠাৎ একদিন বয়ে গেল, তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় ঝড়। মীরাকে জোর করে উঠিয়ে নিয়ে ধর্ষণ করল কয়েকটি শকুন। বাধ্য হয়ে আইনের আশ্রয় গ্রহন করলেন তিনি। কিন্তু এটি তার জন্য আরও কাল হয়ে দাঁড়াল। তিনি আইনের আশ্রয় তো পেলেনই না উল্টো অকালে তার জীবন চাকাই থেমে পড়ল। সমাজের কাছেও ধর্ষিত একমাত্র সন্তানকে নিয়ে টিকে থাকায় আশায় বালি হয়ে গেল।

চারদিকে অন্ধকার ঘনীভূত হলে সব ছেড়ে রাতের অন্ধকারেই বেরিয়ে পড়েন হাত-পা সম্বল করে। কিন্তু না; যে হাত-পায়ের উপর সম্বল করে তিনি এপার বাংলা হতে ওপার বাংলায় পাড়ি জমান, সে হাত-পা তার বিরূদ্ধ আচারণ শুরু করল। ওপার বাংলা পৌছাবার কিছুদিন পর থেকেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। সামার্থ্যের সবটুকু দিয়ে তার চিকিৎসা চলল। কিন্তু যতদিন তিনি একটু দাঁড়াতে পারলেন, ততদিনে তিনি স্ত্রী-কন্যার হাত ধরে পথে পড়েছেন। স্বপ্ন-আশা ভেঙ্গে গেলেও তিনি বাঁচতে চাইলেন, বাঁচাতে চাইলে স্ত্রী-কন্যাকে। তাই বস্তির একটা খুপড়িয়ে ঠাঁই নিয়ে স্ত্রী-কন্যার দু‘মুঠোর ব্যবস্থা করে চললেন। বছরখানেক পর নিজের দূভার্গ্যের সংসার থেকে কন্যাকে মুক্ত করতে বিয়েও দিলেন। কিন্তু বন্দি পাখির মুক্তি মেলে না, আকাশে উড়তে গেলে সূর্য্যের আলোর চোখ জ্বলসে সে পথে পড়ে। বছর দু‘য়েক পর তাই নীরারও পথে আশ্রয় হয়। একমাত্র কন্যার এমন দিনে পিতাই আবার তাই ছায়া হয়ে দাঁড়ায়। এভাবে চলছিল কিছুদিন। কিন্তু বয়স তো আর এসব বুঝে না। সময় গেলে তিনিও ব্যর্থ হতে থাকেন। ধীরে-ধীরে মানুষের দুয়ারে হাত পাতাই এখন বেঁচে থাকার তার একমাত্র উপায়।

অতীতের স্মৃতিচারণ শেষ হলে বিনয় দত্তের হুঁশ আসে। না এভাবে পড়ে থাকলে তো হবে না, তাই আড়মোড় ভেঙ্গে বিনয় উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করে। কিন্তু দাঁড়াবার জন্য তার শক্তি কুলোয় না। শান্ত একটা কানাকানি বাতাসে বয়ে গেলে ধীরগতিতে রাতের গভীরতা বাড়ে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন