বৃহস্পতিবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

মানুষ বেঁচে থাকবে

[গল্পঃ মাতৃহৃদয়
এই কিছুক্ষন আগেই কাদিরমিয়ার পুকুর থেকে স্নান সেরে ঘরে ফিরলাম কানুর সাথে, শীতকালের এই সময়টাতে আমাদের বাড়ির তিনপাশে তিনটে পুকুর থাকলেও ফসলি জমির সেচ করতে-করতে শীতকালে প্রায় পানিশূণ্য হয়ে পড়ে। তাই এই সময়টাতে আমাদের বাড়ি থেকে প্রায় মিনিট পাঁচ-সাতেকের পথ হেঁটে কাদির মিয়ার পুকুরে স্নান সারতে হয়। স্নান করতে গেলেই প্রায় প্রতিদিনই আমাদের গল্পের আসর জমে, চারপাশের ফসলি সবুজ জমি তার মাঝখানটায় গাছগাছালি ঘেরা পুকুরটি সাক্ষী হয়ে যায় আমাদের জীবনে পার করে যাওয়া কতশত গল্পের স্মৃতিকথায়। তাছাড়া কাদিরমিয়ার পুকুটির অবস্থান এমনস্থানে যেখানে শীতকালে পুকুরের পানিতে সূর্যের আলোয় কিছুটা তপ্ত থাকে, ফলে আশপাশের অনেকের পুকুর থাকার স্বর্ত্ত্বেও, শীতের ভয় ভেঙ্গে গোসল করতেও ওখানে ছুটে। যাই হোক স্নান সেরে এসে যখনই ঘরে ডুকলাম, ঠিক তখনই শান্তিঠাকুরমার চিৎকার শুনতে পেলাম। আমাদের বাড়ি হতে প্রধান রাস্তায় বের হতে একশ কদম পার হলেই তাদের বাড়িটি। শান্তিঠাকুরমা সম্পর্কে আমাদের রক্তের জ্ঞাতী, মানে আমার দাদার বাবার পক্ষীয় সম্পর্কের রক্ত। আর আমাদের হিন্দু সমাজে আমরা আজও বোধকরি অনেকে ৭ টা বংশধর পার হওয়া পর্যন্ত জ্ঞাতীকে চেনার চেষ্টা করে।

শান্তিঠাকুরমার চিৎকার শুনে যখন আমি বা আমরা ছুটে গেলাম, তখন দেখতে পেলাম তার মাথা থেকে গরগর করে রক্ত বের হচ্ছে আর তার সতীনপূত্র শংকরকাকাসহ কয়েকজন আকস্মিক আতঙ্ক নিয়ে মাথায় পানি ঢালছে আর ছুটোছুটি করছে। শংকরকাকা মাঝে-মাঝে হুমকি দিয়ে চলছে হালার হুতেরে ধর, হালার হুত ঢাকাইত কৈ গেছে ধর। মাথায় পানি ঢালার কিছুক্ষনপর শান্তিঠাকুরমার হুঁশ ফিরে এলে তাকে জিজ্ঞাসা করে জানা যায় মূল রহস্য। গতকালকেই চাউল শেষ হয়ে গেছে আর তা জানাতে শান্তিঠাকুরমা ভূলে গেলেন। শীতের দুপুরের চড়া রৌদ মাথার উপরে খই ফোঁটার মতো তপ্ত করে রেখেছে, তার উপর সকাল থেকে অসহ্যকর খাটুনী খেটে হারুকাকা যখন ঘরে এসে ভাত খেতে চেয়ে পায় নি, তখনই মায়ের সাথে বাকবিতন্ডার এক পর্যায়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রন করতে না পেরে মায়ের মাথায় লাঠি দিয়ে আঘাত করে পালিয়ে যায়। শান্তিঠাকুরমা সমন্ধে বলতে গেলে- বিধবা শান্তিঠাকুরমার স্বামী গত হয়েছেন ১২ বছরের অধিক সময় পার হয়ে গেছে। তাই আপনার চারছেলে আর একমেয়ে নিয়ে তার সংসার। এছাড়া তার স্বামীর প্রথম ঘরের দুই ছেলে বর্তমান, যার একজন ছোটবেলায় বাবার সাথে ঝড়গা করে ভারতে পাড়ি জমিয়েছে আর বাকীজন শংকরকাকা। স্বামীহারা শান্তিঠাকুরমার সন্তানদের মধ্যে হারুকাকাই সবার বড় আর কর্মঠ, তাই স্বামীর অবর্তমানে সংসারের হাল হারুকাকা হাতেই পরিচালিত হচ্ছে। আর শান্তিঠাকুরমার ভরশার স্থানটাও বোধহয় তাকে ঘিরেই টিকে আছে।

দুইদিন পরের কথা, এই দুইদিন হারুকাকার বাড়িতে চলাচল নেই। সেদিন পালাবার পর কোন অনুশোচনায় অথবা ক্ষোভ অথবা ভয়ে তার আর বাড়িতে পা পড়ে নি। তাই শান্তিঠাকুরমা বাহিরে থেকে বাড়িমুখো সবাইকে জিজ্ঞাসা করছেন- য়াগ্গো হারুরে দেখছচনি? তার কথায় কেউ-কেউ কটাক্ষের সুরে তাকে ভৎসনা দিলেও তাকে দেখে বা তার মতির গতিতে বোঝা গেল- মাতৃহৃদয় কত সহজে সমস্ত ঘৃণা, সমস্ত অভিমান হজম করতে পারে। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষনে পড়েও মাতৃহৃদয় কতটা ছাড় দিতে পারে। কেউই তাকে আশস্ত করে না বা করতে আসে না, তাই মাতৃমমতায় শান্তিঠাকুরমা বেরিয়ে আসেন পথে- স্নেহের ব্যকুলতায়, সন্তানের মমতায় অথবা মাতৃহৃদয়ের হাহাকার ঘুছাতে।]

-উপরের গল্পটি আমার দেখা আমার গ্রাম্য জীবনের বাস্তবতা। কিন্তু এই গল্পটি লেখা এখানে আমার উদ্দেশ্য নয়। আমার উদ্দেশ্য দেখানো- মানুষ কেন বেঁচে থাকে বা থাকতে চায়। মানুষের বেঁচে থাকার লক্ষ্য যে অনেক ধন-সম্পদ, বাড়ি-গাড়ি নয় তা তুলে ধরা। তাছাড়া সামান্য একটু সৌহার্দ্য, মমতা, একটু ভালো লাগা, একটু ভালোবাস, এতখানি আবেগ কিংবা চারসিকির এইটুকু উদ্দেশ্যই মানুষের কাছে তার জীবনকে কতটা অর্থবহ করে তোলে তা দেখানো। এই দেখুন না; একটা ফুল কিংবা প্রজাপতি দেখে তিনি/তারা বলছে- এই দেখ কি সুন্দর ফুল! ঐদেখ কি দারুণ প্রজাপতি! সমূদ্রগতির জলে সমস্ত দেহ ভাসিয়ে বন্ধুদের সাথে সমস্বরে চিৎকার করে সমূদের জোয়ারের শব্দকে স্তম্ভিত করে দে, কখনো আবার নদীর ক্ষুদ্ধ জোয়ারে উৎচ্ছাসিত হয়ে পাড়ে দাঁড়িয়ে বলে নে, আমায় নে। কিন্তু জোয়ারে সে ধরা দেয় না। তবে সব হেলে দ্বীধা-বিভক্ত জীবনকে বেশিরভাগই কাটিয়ে দিতে পারে সন্তানের মুখ দেখে অথবা রাগচটা স্বামী কিংবা অবাধ্য স্ত্রীর ভেতরকার প্রেমের সামান্য পরশে- জীবনের সমস্ত ব্যথাকে প্রণয়ের রঙ্গে রাঙ্গিয়ে।

সত্যি জীবন বাঁচানোর জন্য খুব সামান্য মন্ত্রণারই প্রয়োজন, জীবনকে আরও একটু এগিয়ে নিতে সামান্য বন্ধনের আহ্বানই যথেষ্ঠ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন