শুক্রবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫

বাংলাদেশ, সাম্প্রদায়িকতা, একজন কেজরিওয়াল ও কিছু প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন

বাংলাদেশ
বাংলাদেশ আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি, আমাদের স্বস্তি, আমাদের নিঃশ্বাস। আমাদের নির্ভয়ে চলার অবাধ চারণভূমি, আমাদের প্রতিটি অঙ্গিকার, আমাদের প্রতিটি প্রত্যয় দেশকে জড়িয়ে, আমাদের আশা-ভাষা-স্বপ্ন এই ছোট্ট দেশটাকে ঘিরে।

আসলে কি তাই?

স্বাধীনতা ৪৪ বছরে দাঁড়িয়ে আমি বাংলাদেশ সম্পর্কে যে প্রশ্নটি সকলের সামনে আজ ছুড়ে দিলাম তার আসল-নকল সকলে তাদের বিবেচনায় নির্ণয় করবে, আমি শুধু প্রসঙ্গ-প্রাসঙ্গিকতার কয়েকটি কথা তুলে ধরছি। ৭১ এ মুক্তিযুদ্ধের কারণ কিংবা প্রসঙ্গ যদি বলতে হয় তবে সহজে বলা চলে, এ যুদ্ধের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্থান থেকে আমাদের অধিকার রক্ষার আন্দোলন। আমাদের অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-চিকিৎসা-শিক্ষা সহ মৌলিক অধিকার নিশ্চয়তা। কোনঠাসা জীবনে পড়ে-পড়ে না মরে শেষবারের মতো বেঁচে থাকার প্রত্যয় দেখানোর যুদ্ধ। সেদিনকার যুদ্ধের পূর্বে পাকিস্থানের ধর্ম দোহাইও বাঙ্গালীদের মুক্তির সংগ্রাম হতে পিছু হটাতে পারে নি। কেননা; সেদিন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিঃক্ষনে তারা দাঁড়িয়ে ছিল। সবকিছু মিলিয়ে বলা চলে- অসম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গঠনের জন্য বাংলাদেশ স্বাধীন হয় নি, বরং বঞ্চিত মৌলিক অধিকার আদায়ের প্রতিজ্ঞায় স্বাধীনতা এসেছে। তাহলে- আজ অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের প্রশ্ন কেন? প্রশ্নটির প্রাসঙ্গিকতা দেখার পূর্বে আমাদের যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতিগুলো একটু লক্ষ্য করি নিচের লিংকগুলো হতে-
১)
http://bn.wikipedia.org/wiki/%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%82%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B6%E0%A7%87%E0%A6%B0_%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%A7%E0%A7%80%E0%A6%A8%E0%A6%A4%E0%A6%BE_%E0%A6%AF%E0%A7%81%E0%A6%A6%E0%A7%8D%E0%A6%A7
২) http://www.molwa.gov.bd/kondo.php
[২ নং লিংকটিতে মুক্তিযুদ্ধের দলিলের ১৫ খন্ড পিডিএফ আকারে দেয়া আছে। সকলে ডাউনলোড করে পড়তে পারেন]

এখন আসি প্রাসঙ্গিকতায়-
প্রশ্ন তোলা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে বাঙ্গালির মৌলিক চাহিদা নিয়ে টিকে থাকার আশায়। তবে স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে কেন বাংলাদেশকে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গঠনের প্রশ্ন আসে? তাছাড়া এদেশে ৮৫% মুসলমান অধ্যূষিত হবার দরুন এখানে এ ত ভাবনার বাহুল্যতা।
হ্যাঁ; হতে পারে ভাবনার বাহুল্যতা কিংবা এ যুক্তিযুক্ততার উর্দ্ধে, তারপরও এইদেশ অসাম্প্রদায়িক হতে পারে কারন; এই দেশের ইতিহাস তাতে নির্মাণ হয়েছে বলে। স্বাধীনতার প্রাক্কালে যখন মুসলিম সমাজ বিভক্ত হয়ে পড়ে ধর্মীয় উষ্কানীতে, তখন যুদ্ধের ধকল সবচেয়ে বেশী বইতে হয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে। শতকরা হিসেবে যদি যুদ্ধের সামগ্রিকতা নিরুপন করা হয়, তবে দেখা যাবে যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে এদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় যতটুকু অবদান রেখে গেছে, সংখ্যাগুরুদের শতকরা তুলনায় তা অনেক গুণ বেশী ছিল। নিজেদের কোণঠাসা করেও, নিজেদের সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়ে যারা নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিল সে দিন। বেঁচে থাকা সে নিঃস্ব মানুষগুলোকে সে গোলাম হয়ে থাকতে হবে যাদের বেশীরভাগই চায়নি পাকিস্থান থেকে বাংলাদেশ পৃথক হোক তাদের কাছে?  মৌলিক অধিকারের জন্য সর্বস্ব বিলিয়েও যদি গোলামির জীবন বেঁচে নিতে হয়, তাও আবার পাকিস্থানকে মৌণসম্মতি দানকারীদের কাছে, তবে এখানে স্বপ্নচারীদের কি পাওয়ার আছে? তাদের অভ্যর্থনার সাধ কৈ?
আমার বন্ধুরা বলে- ইসলাম শান্তির ধর্ম, ইসলাম ধর্মের উপর প্রতিষ্ঠিত দেশ হলে আমরা সকলে শান্তিতে থাকব। একমাত্র ইসলাম সবধর্মকে সমানদৃষ্টিতে দেখতে শেখায়। আমি এর সত্যতা যাচাই করতে চাইনি, কিন্তু সময়ের তোপে আজ সে করতে হল। আজ আমাকেও প্রশ্ন তুলতে হল সত্যি কি ধর্মের উপর প্রতিষ্ঠিত কোন রাষ্ট্রে শান্তি বিরাজমান? দুঃখিত আমার বন্ধুরা, কথাটা এভাবে বলার জন্য। আমি সত্যতা যাছাই করতে চাইছি। আমি জানি প্রতিটি ধর্ম তার অনুসারীদের কাছে অনেক শ্রদ্ধার, সবধর্মই সত্যের উপর নির্ভরশীল, সব ধর্মই মান্য করে- সৎ জীবন যাপন, সদাচারণ, সহিষ্ণুতা, সদালাপ, মানবতা, প্রার্থনা, শুচিতা, পবিত্রতা ইত্যাদি। সবকিছু ঠিক থাকার পরও ঠিক কি কারণে এত-এত ধর্ম পৃথিবীতে ছড়িয়ে আছে?  
হ্যাঁ; তার কারণ আছে, তার স্পষ্ট কারণ বর্তমান। পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত প্রতিটি ধর্মের এমন একটি আদিম দিক আছে, যা ধর্মকে ধর্ম হতে ভিন্ন করে, মানুষকে মানুষ হতে বিভাজিত করে। যেমনঃ পবিত্র কোরআনের নির্দেশনাই যদি আমরা দেখি তবে দেখি, কোরআন নির্দেশনা দেয়- “ইহুদী নাসারা ইসলামের শত্রু।” -এর অর্থ কি দাঁড়ায়? এর অর্থ দাঁড়ায় ইসলামের জন্মশত্রু ইহুদী ছাড়াও, নাসারা অথাৎ যারা বহুদেবতায় বিশ্বাসী বা প্রার্থনা করে, তারাও ইসলামের চোখে শত্রু।’ শুধু এই একটি বাক্যই এক ধর্মের মানুষ হতে অন্যধর্মের মানুষকে বিচ্ছিন্ন করতে, তাদের প্রতি ভীতি সঞ্চারিত করতে যথেষ্ঠ। কেননা; মুসলমান‘রা এই দুই জনগোষ্ঠীদের যখন জন্ম থেকে শত্রু জ্ঞান করে আসছে, তাই এদের সামান্য ভূলভ্রান্তিকেও তারা আকাশসম ভাববে তা স্বাভাবিক। তার প্রকটতাও আমাদের কাছে এতোমধ্যে স্পষ্ট আছে, যেমন- ১৯৫১ সালে বঙ্গবঙ্গ আন্দোলনের পূর্ববর্তী সময়ে যে পাকিস্থানে হিন্দুদের সংখ্যা ছিল শতকরা ২২%, ২০১২ সালে এসে সে তা ঠেকেছে প্রায় ১% এ। অথচ বঙ্গবঙ্গ আন্দোলনের সময় ৮ মিলিয়ন হিন্দুদের মধ্যে ৪.১ মিলিয়ন মানুষ ভারতে গমন করেছিল। তাহলে বাকী‘রা কৈ? রেফারেন্স লিংক দেয়া আছে- [http://en.wikipedia.org/wiki/Hinduism_in_Pakistan]

অথচ বাংলার মুসলমান‘রা ভারতে বাবরি মসজিদের দোহাইয়ে, মুসলমানদের মেরে ফেলছে বলে ১৭% হিন্দুতের কমিয়ে আজ ৭% এ দাঁড় করিয়েছে। অথচ বিশ্বাস না করলেও এ সত্যি, যেখানে বলা হয়েছে ভারতে মুসলমানদের সব মেরে ফেলা হচ্ছে সেখানে তারা ৯% তে ১৫% এ উর্নীত হয়েছে।
অতএব নিজেদের নিঃস্ব করে অর্জিত কলার ভাগাভাগি করে খাবে সম্প্রদায়িকতার মুখোশ পড়ে, আর নিঃস্ব‘রা দিনে-দিনে আরোও নিঃশেষ হয়ে গোলামী করাটাকে মেনে নেবে? এ কি বিবেক বর্জিত নয়?  আর স্বাধীনতা এ ত অর্জন, এ অর্জন মানতে ধর্মীয় বিষবাষ্প ছড়ানোর চেষ্টা কেন? এর উদ্দেশ্যও বা কি?

বাংলাদেশের বর্তমান
যে সশস্ত্র রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশ তার দ্বীপ্ত প্রজ্জ্বলিত শিখা জ্বেলেছে, সে শিখার আলো কতকটা ছড়িয়েছে তা আমরা আমাদের বর্তমান বাংলাদেশের অবস্থান থেকে সহজেই নিরুপণ করতে পারি। মানুষের মৌলিক চাহিদা আদায়ের লক্ষ্যে যে অর্জিত স্বাধীনতা, সময়ে সে দিন বদলে গিয়ে রূপ নিয়েছে পিতৃপ্রদত্ত, স্বামীপ্রদত্ত কিংবা সাম্প্রদায়িক সম্পদে। অর্জন যখন সম্পদ হিসেবে পরিগনিত হয়- তখন তা ভাগবাটোয়ারা হবে, ভাগ নিয়ে চুরি-চোছামি হবে, মার-দাঙ্গা হবে, খুন-খারাবি হবে এ ত স্বাভাবিক। আর এই স্বাভাবিকতাই একদিন সমস্ত জীবনকে অস্বাভাবিক করে দেবে, দিচ্ছেও।
হ্যাঁ; আজ আমরা কেবল অস্বাভাবিকতাকেই আশ্রয় করে চলছি, আমরা বুঝতে পারবি না, আমাদের কি ঠিক আর কি বেঠিক। আমাদের আদর্শ আমাদের মতাদর্শ এখন কেবল টিকে থাকার। পাশে কে আছে, কিভাবে আছে সে ভাববার মতো কশরত আমাদের নেই। শক্তি বা ক্ষমতা এই এখন কেবল টিকে থাকবার হাতিয়ার। আর এই হাতিয়ার- দিনকে দিন জনজীবনকে যে পরিমান বিষিয়ে তুলছে, তাতে সকলই মুক্তি পেতে চাচ্ছে। সকলেই আজ দিন গুনছে একজন কেজরিওয়াল এসে আমাদের এই ভয়াল দিনে হাল ধরুক। আমরা ক্ষমতার হালুয়া-রুটি ভাগাভাগি থেকে মুক্ত করুক। কিন্তু আমাদের কেজরিওয়াল কে? আমাদের মুক্তির নিঃশ্বাসে তার উত্থান কি আদ্যৌ সম্ভব? সম্ভব অসম্ভব সে ভেবে পাই না, শুধু খুঁজে বের করার চেষ্টা করি- কে; ঠিক কে বেরিয়ে আসবে আমাদের জন্য কেজরিওয়াল হয়ে। যার আগমনে ধুমড়ে-মুছড়ে পড়বে, এই বঙ্গকে নিজের বাবার সম্পদ, স্বামীর সম্পদ কিংবা সাম্প্রদায়িক সম্পদের বিষাক্ত নিঃশ্বাস হতে?

কেজরিওয়াল
কে এই কেজরিওয়াল? এ বলতে হবে না আজ কাউকে। শুধু যে কথাটি তার জন্য বলার আছে, সে হল- তিনি বিজেপির দাম্ভিকতা গুড়িয়ে দেবার প্রতীক। তিনি দেশটাকে যে কংগ্রেস নিজের সম্পদ করে নিয়েছিল, সে সম্পদ যে জনগনের সম্পদ তা চোখে আঙ্গুল দিয়ে বুঝিয়ে দেবার প্রতীক। মানুষ যে আবদ্ধ শিকল থেকে বের হতে চায়, সে চাওয়ার প্রতীক। রাজনীতির রাজ্যে কেজরিওয়াল দুধের শিশু বটে, তবে সে শিশুর প্রতি মানুষের আকাঙ্খা অনেক। মানুষ অনেক আশা করে তাকে বড় হবার সুযোগ করে দিয়েছে। তার বড় হবার পাশাপাশি দেশের মানুষের সৌভাগ্য আসবে, সে আশা করে আছে। জানি না কেজরিওয়াল কতটুকু কি পারবে অথবা নিজেকে কতটা বিস্তার ঘটাবে। তবে কিছু পারুক বা না পারুক তিনি গণমানুষের আপাত প্রতীক হয়ে আছেন, সামষ্টিক বিচারে এটাই এখন বড়। কিন্তু বড় সে তার সীমানায়, তার গন্তব্যে, পাশ্ববর্তী ভারতের দিল্লিতে। তবে তার ডিমে তা দিয়ে আমাদের কি পয়দা? আমাদের তো আমাদের কেজরিওয়াল এর খোঁজ পেতে হবে। তাই মিলিয়ে নেই আমাদের সম্ভবনাময়ী কেজরিওয়ালদের। মিলাতে-মিলাতে মনে পড়ে যায় শেখ মুজিবের একটা কথা- “সবাই পায় সোনার খনি, আর আমি পেলাম চোরের খনি।”  বঙ্গবন্ধু সেদিন ভূল বলেছে সে কথা আজও মনে করতে পারছি না। দেখে চলছি, যা ভেবে পাচ্ছি, সব জায়গায় এই একটি কাজই চলছে নিরবে নিভৃতে। যে যেখানে সুযোগ পাচ্ছে সেখানেই তারা চুরি করছে। হয় কাজ চুরি, না হয় সময় চুরি, না হয় বিশ্বাস চুরি, নয়তো সম্পদ চুরি অথবা প্রেম-স্নেহ-মায়া-মমতা চুরি। সব জায়গায়-জায়গায় আজ লুটেরা বসে আছে ঘাপটি মেরে, সময়ের অপেক্ষা করে। তবুও আমরা বিশ্বাস রাখছি আমাদেরও একদিন একজন কেজরিওয়াল আসবে, যে সব খান-খান করে ভেঙ্গে-ছুরে নতুন করে গড়বে।

উপসংহার
প্রাচীনমানুষ প্রথমে ফলমূল শাকসবজি খেতে শিখেছে, তখন তাই তাদের প্রিয় খাবার ছিল। এরপর তারা ক্রমান্নয়ে মাছ আর পশু শিকার করতে শিখল, তখন মাছ-মাংস প্রিয় খাবারে পরিনত হল। তারা বংশবিস্তারে আদিম খেলা শিখল, সেও তাদের প্রিয় হল। এখন তারা খুন করতে শিখেছে, এটাও এখন প্রিয়রূপ হয়েছে। দেশে-দেশে এখন রক্তের হোলি খেলাটাই এখন প্রিয় খেলার একটি। এই খেলার প্রাথমিক শিকার হচ্ছে সংখ্যালঘুরা, তাদের পরিমান কমে গেলে কিংবা শেষ হয়ে আসলে চলে নিজেদের মধ্যে হোলি খেলার লড়াই। আমার কথা মানতে হবে না- শুধু দেখুন ক্ষোভ আর ক্রোধের প্রণয়ে মজে যে খেলা শুরু হয়, পরস্পর পঙ্গু হবার আগ পর্যন্ত সে খেলা  কিংবা ক্ষুধা কমে না। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন